ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রশাসনসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নামে একের পর এক মামলা হচ্ছে। যার বেশির ভাগই হত্যা বা হত্যাচেষ্টার মামলা। এর মধ্যে সরকারের সচিব এবং সাবেক সচিব মিলে ৫৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। আছেন পুলিশসহ অন্যরাও। এসব মামলার কারণে দুশ্চিন্তা কমছে না কর্মকর্তাদের। যাদের নামে মামলা হয়েছে-তারাও উদ্বিগ্ন, যাদের নামে হয়নি-তারাও আছেন টেনশনে। এতে তাদের কাজের ক্ষেত্রে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। ঢালাও মামলার কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে সব কর্মকর্তার মধ্যেই। কারণ প্রশাসন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কৃষি কর্মকর্তাদের নামেও মামলা হয়েছে। এতে কৃষিতে কর্মরতদের দুশ্চিন্তায় স্থবিরতা দেখা গেছে সরকারি কর্মকাণ্ডে। সম্প্রতি সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও কয়েকটি অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে। মামলার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত হচ্ছে নানা রদবদল। কর্মকর্তাদের নামে অর্ডার হয়ে সেটি আবার বাতিল হচ্ছে। কবে কার নিজ মন্ত্রণালয় বা দপ্তরে শেষ অফিস করতে হবে- জানে না কেউ। আবার কবে কার ওএসডি অর্ডার হবে- এসব নিয়েও রয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের নানা দুশ্চিন্তা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হুটহাট একের পর রদবদল আদেশ হচ্ছে। আবার বিগত সরকারের সময় কিছু কর্মকর্তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে অন্য কর্মকর্তাদের ঢালাওভাবে মামলা দেওয়ায় কাজের ক্ষেত্রেও নানা প্রভাব পড়ছে। কেউ স্বস্তিতে নেই। অভিযোগ উঠেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করাসহ চাঁদাবাজি ও হয়রানি করতেও অনেককে এসব মামলায় আসামি করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলায় ‘ইচ্ছামতো’ আসামি করা নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে। এ বিষয়ে সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢালাও মামলা যারা করছেন-তারা অন্যায় করছেন। মামলা সুনির্দিষ্টভাবে হওয়া উচিত। যারা জ্ঞানত কোনো অন্যায় করেনি, তাদেরও ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। অনেকের নামে মামলা হলে বোঝা যায় এসব ভুয়া। যেহেতু এখন কিছুটা উল্টাপাল্টা হচ্ছে, তাই কর্মকর্তাদের মামলার বিষয় আমলে নেওয়ারও দরকার নেই, ইগনোর করারও দরকার নেই। এসব একসময় ঠিক হয়ে যাবে।
জানা যায়, মামলার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হলেও মামলা থেমে নেই। গত ১৩ সেপ্টেম্বর এই নির্দেশনায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য ঘটনা ঘিরে যেসব মামলা হচ্ছে, সেগুলোর প্রাথমিক তদন্তে কোনো আসামির সম্পৃক্ততা পাওয়া না গেলে, মামলা থেকে তার/তাদের নাম প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছিল। একই সঙ্গে সঠিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়া এসব মামলায় কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বলেও নির্দেশনা দেওয়া হয়। গত ২৯ অক্টোবর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ছাত্রদলের সাবেক নেতা মোহাম্মদ জামান হোসেন খানের করা এক মামলায় ১৯৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। যার মধ্যে সচিব এবং সাবেক সচিব মিলে ৫৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। আছেন পুলিশসহ অন্যরাও। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন মামলায় বিচ্ছিন্নভাবে সাবেক কয়েকজন সচিবকে আসামি করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আসামিদের তালিকায় থাকা একাধিক সাবেক সচিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এরকম ঢালাও মামলা হওয়ায় মামলার যে একটা নিজস্ব গুরুত্ব আছে সেটা কমে যাচ্ছে। এতে আমাদের পরিবার উদ্বিগ্ন হচ্ছে, পেরেশানি বাড়ছে। অথচ এতে আরেক দিকে যারা প্রকৃত আসামি, তারা পাড় পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে।
কৃষিতেও অস্বস্তি : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে একটি মামলায় ৭৮ কৃষি কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। যার মধ্যে ৭৬ জন রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে (ডিএই) কর্মরত। এতে অস্বস্তি বিরাজ করছে কৃষিতেও। আসামিদের মধ্যে ২৫ জন প্রকল্প পরিচালক, তিনজন নারী কর্মকর্তা ও তিনজন উপপ্রকল্প পরিচালকও আছেন। এমন মামলার পর মামলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেলেও মামলার প্রভাব পড়েছে কৃষির মাঠপর্যায়ে। এতে অনেক কর্মকর্তা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত এবং কাজে মনোযোগী হতে পারছেন না। কেউ কেউ মনে করছেন কৃষি কর্মকর্তাদের এভাবে মানসিকভাবে দমিয়ে দিলে কৃষি উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটবে। এ বিষয়ে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলার বাদী লেখাপড়া জানে না। অথচ আমাদের কর্মকর্তাদের নাম আইডিসহ মামলা করেছেন। এতে বোঝা যায় এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমাদের উপদেষ্টা এ বিষয়ে কথা বলেছেন সংশ্লিষ্ট থানায়। আমরাও জানার চেষ্টা করছি এর পেছনে কারা? তিনি আরও বলেন, অযথা হয়রানি করা হবে না আমাদের কর্মকর্তাদের। প্রয়োজনে আমরা আইনগত সহায়তা দেব। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের গত সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে ঢালাও মামলা নিয়ে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ভুক্তভোগী ব্যক্তি যদি মামলা করেন, তাহলে তাকে মানা করা যায় না। তবে যাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই, দ্রুত তদন্ত করে তাদের নাম বাদ দিতে বলা হয়েছে। পুলিশকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।