কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ থাকলে এবং আদালত মনে করলে দল নিষিদ্ধ বা প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করতে পারবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এমন বিধান রেখে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল), ১৯৭৩ অধ্যাদেশের সংশোধন প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। খসড়াটি অনুমোদনের জন্য আজ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সংগঠন বা দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার ও নিষিদ্ধ করতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করার বিধান রেখে এ আইনের সংশোধন প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকার তা করে যেতে পারেনি।
জানা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩’ প্রণয়ন করে। ২০১০ সালে শেখ হাসিনার সরকার এ আইনের আওতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এ ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে বিচার করে রায় দেন। পরে সে রায় কার্যকর হয়। একই অপরাধের অভিযোগে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল শাসক আওয়ামী লীগ।
সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছেন, সংশোধন প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করে অল্প সময়ের মধ্যে তা অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করা হবে। যেহেতু দেশে এখন সংসদ নেই। এ অধ্যাদেশের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধনী) অধ্যাদেশ, ২০২৪’। প্রস্তাবিত খসড়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিধি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব অপরাধ বিচারের শুনানিতে ঘটনা সম্পর্কে অডিও-ভিডিও তথ্যকে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করার বিধানও প্রস্তাব করা হয়েছে। বাংলাদেশ ভূখে র ভিতরে মানবতাবিরোধী কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সে অপরাধের বিচারের কথা বলা আছে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে। সেখানে অপরাধের সীমানা হিসেবে বাংলাদেশের জলসীমাকেও যুক্ত করা হয়েছে খসড়ায়। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল গতকাল সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন পরেন। উপদেষ্টা বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এ কিছু মারাত্মক বিচ্যুতির কথা দেশিবিদেশি মানবাধিকার সংগঠন বলেছিল। সুশীলসমাজও বিভিন্ন সময় বলেছিল। সরকার যখন এটি সংস্কারের উদ্যোগ নিল, তখন সরকার চেয়েছে বিচারটি যেন দেশি ও বৈশ্বিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য হয়। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে যেন সুবিচার সুনিশ্চিত করা হয়। এজন্য ব্যাপক পরামর্শ করা হয়েছে। একটি অসাধারণ সংশোধন করার জন্য চেষ্টা হয়েছে; যেটি এর বিচারের গুরুত্ব, যৌক্তিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা অনেক বাড়িয়ে দেবে। আইন উপদেষ্টা জানান, আজ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সেই সংশোধনের খসড়া তোলা হবে। উপদেষ্টা পরিষদ এটি গ্রহণ করলে প্রক্রিয়াগত কারণে যত দিন লাগে, তত দিন পরে এটি অধ্যাদেশ হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশের সংশোধন প্রস্তাবের খসড়ায় রাজনৈতিক দলের বিচারের ধারা যুক্ত হচ্ছে কি না-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, এ বিষয়ে একটি দিন অপেক্ষা করেন, দেখবেন। খসড়ায় কী আছে-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রস্তাবে যেটি আছে, সেখানে আদালতকে সেভাবে সরাসরি ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, আদালত যদি মনে করেন তাহলে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তাঁরা সুপারিশ করতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করবেন।
যেসব পরিবর্তন আসছে : সূত্রের তথ্যানুযায়ী সংশোধনে মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিধি বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে গণহত্যা, হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণ, দাসত্ব, লুটপাট, নির্মূল (কোনো একটি গোষ্ঠীকে), অবরুদ্ধ, নির্বাসিত, কারারুদ্ধ বা অন্য কোনো অমানবিক কাজকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এখন গুম, যৌনদাসী বানানো, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, জোরপূর্বক গর্ভধারণ, জোরপূর্বক বন্ধ্যত্বকরণের মতো বিষয়গুলোকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে যুক্ত করার প্রস্তাব আনা হচ্ছে।
আইনে উল্লেখ করা অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে কোনো কমান্ডার অথবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নির্দেশ বা অনুমোদন দিলে এবং ঘটনায় সরাসরি অংশ নিলে তাদের বিচার করার কথা বলা আছে। এখন কমান্ডার, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতাকেও বিচারের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। খসড়ায় গুম, যৌনদাসী বানানো, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, জোরপূর্বক গর্ভধারণ করানোর মতো বিভিন্ন বিষয়ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এসব অপরাধের বিচারের শুনানিতে ঘটনা সম্পর্কে অডিও-ভডিও তথ্যকে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করার বিধানও প্রস্তাব করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাকে যে কোনো স্থানে তল্লাশি করে নথিপত্র জব্দ করার ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি অনুমতি নিয়ে ট্রাইব্যুনালে শুনানি, তদন্তসহ অন্যান্য কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। ভুক্তভোগী বা তার প্রতিনিধি ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। সাক্ষীর সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ও যুক্ত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ভূখে র ভিতরে মানবতাবিরোধী কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে সে অপরাধের বিচারের কথা বলা আছে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে। সেখানে অপরাধের সীমানা হিসেবে বাংলাদেশের জলসীমাকেও যুক্ত করা হচ্ছে। এমনকি অন্য দেশে কোনো বাংলাদেশি মানবতাবিরোধী অপরাধ করলে তাকেও এ আইনের আওতায় এনে বিচার করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ভূখ ও জলসীমায় অন্য কোনো দেশের নাগরিক মানবতাবিরোধী অপরাধ করলে তারও বিচার এ আইনে করার বিধান রাখা হচ্ছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় ৫ আগস্ট। স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে সরকারি হিসাবে ৮৭৪ জন নিহত হন। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ ওঠে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণহত্যা ও আওয়ামী লীগের শাসনের সময়ে গুমের অভিযোগগুলোর বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে বিচার কার্যক্রমের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। একই সঙ্গে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে আইনটি সংশোধনের।