রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্ববিহীন কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন হারাবে অন্তর্বর্তী সরকার। আর রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন হারালে অন্তর্বর্তী সরকার এক সপ্তাহও টিকবে না বলে মন্তব্য করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি এবং ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর।
গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি আরও বলেন, দেশের বর্তমান সংকটময় অর্থনৈতিক অবস্থায় সরকারকে অবশ্যই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশে ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। সরকারের জন্যও এটি বিপর্যয়ের কারণ হবে। ডাকসুর সাবেক ভিপি বলেন, সরকারের যদি কোনো কিংস পার্টির প্রতি সমর্থন থাকে এবং এ বিষয়ে যদি পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হবে। ইতোমধ্যেই এমন কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় এবং দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এ জন্যই রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচন চাইছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
নুরুল হক নুর : আমাদের প্রত্যাশা অন্তর্বর্তী সরকার আন্দোলনের অংশীজনদের নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠন করবে। জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে রাষ্ট্র সংস্কার করে ব্যবস্থা করবে সুষ্ঠু নির্বাচনের। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য মাঝখানে যে সময়টুকু প্রয়োজন তার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর অংশীদারত্ব এবং অংশগ্রহণ প্রয়োজন। যে সংস্কার কমিশনগুলো গঠিত হয়েছে, সেগুলোতে কোনো রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নাই। রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ এবং প্রতিনিধিত্ববিহীন কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন হারাবে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন হারালে এই সরকার এক সপ্তাহ টিকে থাকতে পারবে না। সরকারের প্রতি আমার পরামর্শ হবে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ান। জন-আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচনি এবং রাষ্ট্র সংস্কারের রোডম্যাপ জনগণের সামনে উপস্থাপন করুন।
দেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে ঢালাও মামলার বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
নুরুল হক নুর : ঢালাও এবং গায়েবি মামলার সংস্কৃতিকে আমি এবং আমার দল কখনোই সমর্থন করে না। শুধু ভিন্নমতের কারণে যে নিপীড়নের মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি, আমরা চাই না এই গণ অভ্যুত্থানের পর একই কারণে আর কেউ এমন নিপীড়নের শিকার হোক। কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর মানুষ মানুষকে ব্ল্যাকমেল করতে, অবৈধ ফায়দা নিতে, ব্যবসায়িক সুবিধা নিতে, কারও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে কিংবা রাজনৈতিকভাবে কাউকে কোণঠাসা করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এসব গায়েবি মামলা করছে। উদাহরণস্বরূপ, আমি শুনেছি বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামেই মামলা হয়েছে। আমরা যারা গণঅধিকার পরিষদের হয়ে লড়াই-সংগ্রাম করেছি, তাদের নামেও ছাত্র হত্যার মামলা হয়েছে। এসব ঘটনা মোকাবিলা করা সরকারের জন্য খুবই চ্যালেঞ্জিং কাজ। কারণ দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় সরকারকে অবশ্যই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশে ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। সরকারের জন্যও এটি বিপর্যয়ের কারণ হবে।
নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতার কারণ কী?
নুরুল হক নুর : নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এর পেছনেও যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। শুরুর দিকে কোনো রাজনৈতিক দলই বলেনি যে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। এরপর সরকারের ১০০ দিনের কর্মকাণ্ডে মানুষের মধ্যে কিছুটা সন্দেহ-সংশয় তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে এই গণ অভ্যুত্থানের ফ্রন্টলাইনে যেসব ছাত্রনেতা ছিলেন, তারা রাজনৈতিক দল করার কথা বলছেন। তারা সরকারে থেকে সরকারি সুবিধা নিয়ে যদি কিংস পার্টি গঠন করেন, তাহলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেবে না। আমরা অতীতে দেখেছি, অনেকেই সরকারে থেকে কিংস পার্টি গঠন করেছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনটা কোনো একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা ছাত্রসংগঠন করেনি। সব মত-পথের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গণ অভ্যুত্থান সফল হয়েছে। এখন সরকারের যদি কোনো কিংস পার্টির প্রতি সমর্থন থাকে এবং তারা যদি পৃষ্ঠপোষকতা করে তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হবে। ইতোমধ্যেই এমন কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সন্দেহ-সংশয় এবং দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এ জন্যই রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচন চাইছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেছেন, ২০২৫ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?
নুরুল হক নুর : অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এক বছর নিশ্চয়ই উপযুক্ত সময়। যদি তারা চায়, তবে এক বছরের মধ্যে করতেও পারে। এক বছরের অধিক সময়ও যদি তাদের প্রয়োজন হয়, সেটি হতে পারে এক বছর, ছয় মাস, দুই বছর-সেটিও তাদের দেওয়া দরকার। একটা বিষয়ে আমাদের সবাইকে পরিষ্কার থাকতে হবে যে শুধু নির্বাচন এবং ভোটের দাবিতে এই গণ অভ্যুত্থান হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো ১৭ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। কিন্তু গণ অভ্যুত্থান ঘটেনি। ফ্যাসিস্ট সরকারকেও ফেলে দিতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ছাত্র-নাগরিক সবাই এটা বুঝতে পেরেছে যে সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাই নিপীড়নমূলক হয়ে উঠছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে তখন এগুলোর বিরুদ্ধে তারা রাস্তায় নেমে এসেছে। তারা এখন চায় রাষ্ট্রকে পুনর্গঠন করতে। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন। সেই সময়টুকুই এই সরকারকে দিতে হবে। এই সরকার যদি সেই সংস্কারটুকু না করতে পারে, তাহলে আর কোনো সরকার এটি করতে পারবে না।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
নুরুল হক নুর : আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছরে দেশের গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে গিয়ে মানুষের ওপরে জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার চালিয়েছে। তাতে করে তারা এখন মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র। দেশের মানুষ তাদের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সেটি দেখিয়ে দিয়েছে। এরপর আর আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নাই। এতগুলো হত্যাকাণ্ডের পরও যদি তারা স্বাভাবিক রাজনীতি করার সুযোগ পায়, তাহলে পরবর্তী সময়ে যারা ক্ষমতায় আসবে, তারাও ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এ ধরনের বেপরোয়া হয়ে উঠবে। গণহত্যা চালাবে। নির্যাতন-নিপীড়ন চালাবে। তারা মনে করবে যে সময়ের ব্যবধানে মানুষ এসব কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হিসেবে নেয়। এ রকম মানবতাবিরোধী অপরাধের পর, এখনো আহতরা হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে, নিহতদের পরিবার আহাজারি করছে। এই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।
শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারের বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
নুরুল হক নুর : যেহেতু এই গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন শেখ হাসিনা। সুতরাং তাকে বিচারের মুখোমুখি করতেই হবে। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জনগণের কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর পরিষ্কার দাবি, এই গণ আন্দোলনে গণহত্যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত যদি বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চায়, তাদের উচিত বন্দিবিনিময় চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়া এবং বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের আলোকে শেখ হাসিনাসহ গণহত্যার সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা।
অন্তর্বর্তী সরকার ১০০ দিনে কতটুকু প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে?
নুরুল হক নুর : প্রত্যাশা পূরণের জায়গায় একটা বড় রকমের ধাক্কা আমরা খেয়েছি। গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই সরকার গণ আন্দোলনের অংশীজনদের নিয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি। কিন্তু আমরা দেখলাম, সরকার গঠিত হয়েছে এমন কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে যাদের এই গণ আন্দোলনে খুব বেশি সম্পৃক্ততাও ছিল না। এখানে আমরা কিছুটা ধাক্কা খেয়েছি।
আমাদের প্রত্যাশা ছিল দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং জনজীবনে স্বস্তি ফিরবে। কিন্তু এখনো মনে হচ্ছে পরিপূর্ণ স্বস্তি মেলেনি। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে মানুষ কষ্টে আছে। এ ছাড়া ১০০ দিনের মধ্যে সরকার আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারেনি। সে জন্য তাদের রাস্তায় নামতে হলো। অথচ সরকারের প্রধান কাজই হওয়া উচিত ছিল আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা।
নির্বাচনের জন্য গণঅধিকার পরিষদের প্রস্তুতি কতটুকু? বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়েছে কী?
নুরুল হক নুর : বিএনপি আমাদের রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামের সহযোদ্ধা। তবে ৫ আগস্টের পর বিএনপির তৃণমূল কর্মীদের দ্বারা আমরা কোথাও কোথাও বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। এ বিষয়টি অফিশিয়ালি বিএনপির হাইকমান্ডকেও জানিয়েছি। এরপর আমার এবং গণঅধিকার পরিষদের সেক্রেটারির নিজ নিজ এলাকায় দুটো চিঠি পাঠিয়ে বিএনপি তাদের দলের নেতা-কর্মীদের আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করার কথা বলেছে। বিএনপির সঙ্গে কোনো নির্বাচনি জোট আমরা এখন পর্যন্ত করিনি। আমরা এটিকে স্বাগত জানিয়েছি।
গণঅধিকার পরিষদ একটি উদীয়মান রাজনৈতিক দল। গত ছয়-সাত বছর ধরে আমরা আপসহীন রাজনীতির চর্চা করে আজকের অবস্থানে এসেছি। এমপি হতে চাইলে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করেই আমরা সংসদে যেতে পারতাম। আমাদের লক্ষ্য বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় একটা গুণগত পরিবর্তন আনা। বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এতকাল ধরে উপেক্ষার শিকার হওয়া বাংলাদেশের তরুণদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা। মানুষের সামনে বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব তুলে ধরা। ৩০০ আসনেই আমাদের নির্বাচন করার পরিকল্পনা রয়েছে এবং কার্যক্রম চলছে।
নির্বাচন কমিশন সংস্কার এবং কমিশনের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
নুরুল হক নুর : সার্চ কমিটির কাছে গণঅধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে আমরা দশ ব্যক্তির তালিকা দিয়েছি। আমরা চাই সরকার দলনিরপেক্ষ এবং দক্ষ ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেবে। যাদের সরকার নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবে, তাদের নাম গণবিজ্ঞপ্তি আকারে গণমাধ্যমে প্রচার করে, তাদের বিষয়ে জনমত যাচাই করে তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া।