বেইলি রোড আর বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের ইতিহাস, একে অপরের পরিপূরক। তবে কাগজে-কলমে রাস্তার নাম রয়ে গেলেও বেইলি রোডের নাটক সরণিতে এখন মঞ্চকেন্দ্রিক ব্যস্ততা খুবই কম। এখন তো মহিলা সমিতির মঞ্চে নাটকের শো হয় কালেভদ্রে। আভিজাত্য আগের মতো অটুট থাকলেও অতিমাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণে স্বকীয়তা হারিয়েছে বেইলি রোড। হারিয়ে গেছে ‘নাটকপাড়া’র খ্যাতি। সব মিলিয়ে নাটকপাড়ার পালাবদলের গল্প তুলে ধরেছেন - পান্থ আফজাল
দীর্ঘ চার যুগের বেশি সময় ধরে নাট্যচর্চা হয়েছে বেইলি রোডকেন্দ্রিক। ভাঙাচোরা মিলনায়তনে বসেই বছরের পর বছর নাটক উপভোগ করেছেন দর্শক। এমন অনেক দর্শক আছেন যারা মিলনায়তন চত্বরে প্রতিদিন এসেছেন শুধু নাটক দেখতেই নয়, শিল্পের আঙিনায় মেলবন্ধন ঘটাতেও। সেসব আগন্তুকের প্রাঞ্জল উপস্থিতির কারণে নাটকপাড়া সব সময় সরব থাকত। আবার এখান থেকে রাজধানীর যে কোনো স্থানে যাতায়াতও খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। তাই বেইলি রোডের মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস একসময় হয়ে ওঠে নাট্যপ্রেমীদের প্রাণের অঙ্গন। ছুটির দিন তো বটেই, শান্তিনগর চৌরাস্তা থেকে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মোড় পর্যন্ত সপ্তাহজুড়েই জমত নাট্যপ্রেমীর ভিড়। মঞ্চনাটকের গুরুত্ব বিবেচনায় সিটি করপোরেশন বেইলি রোডের নামকরণ করে ‘নাটক সরণি’। এরপর বেইলি রোডের যুগ অবসান ঘটিয়ে সেগুনবাগিচার শিল্পকলার যুগের শুরু হয়। এখন শিল্পকলাই মূলত মঞ্চনাটক প্রদর্শনীর মূল স্থান।
এখন বেইলি রোডের সাগর পাবলিশার্স ঘিরে টিকিট সংগ্রহের সেই প্রতিযোগিতাও নেই। নাটক সরণি হয়ে উঠেছে রাজধানীর ভোজনরসিকদের অন্যতম আকর্ষণ। শাড়ি, খাবার, গহনা আর অভিজাত দোকানের পসরা বসেছে সেখানে। রাস্তার এ মাথা ও মাথাজুড়ে প্রতিটি ভবনে গড়ে ওঠা অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। বইপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, বেইলি রোডের নামকরণ নিয়ে আছে বিতর্ক। সপ্তদশ শতকে মহিশূরের টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ব্রিটিশ সেনাপতি কর্নেল উইলিয়াম বেইলির নামে এই রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল বলে অনেকের মত। আবার ওয়াহাবি আন্দোলন দমনে ভূমিকা রাখায় ব্রিটিশরা স্পেশাল বেঙ্গল পুলিশের ডিআইজি এইচ বেইলির নামে ‘বেইলি রোড’ নাম দিয়েছিল বলেও কেউ কেউ মনে করেন। তবে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মত হলো, বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর (১৮৭৯-১৮৮২) স্যার স্টুয়ার্ট বেইলির নামানুসারে এই রাস্তার নাম রাখা হয় বেইলি রোড।
নামকরণের নেপথ্যে যা-ই থাকুক, বেইলি রোডের নাম ছড়িয়েছিল মূলত এখানকার দুটি মঞ্চ- মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস মঞ্চ। আর এ দেশে মঞ্চনাটকের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে স্বাধীনতার পর। এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাটক মঞ্চায়ন হলেও বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনেই প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাটকের মঞ্চায়ন শুরু হয়। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘বাকি ইতিহাস’ই হচ্ছে দর্শনীর বিনিময়ে এ দেশে প্রথম মঞ্চনাটক। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের ‘গাইড হাউস’ মিলনায়তন। নাটক নয়, বইপ্রেমীদের কাছে বেইলি রোড পরিচিত ছিল ‘বইপাড়া’ হিসেবে। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এর গুরুত্বও ছিল অপরিসীম। দেশবরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের পদচারণে সরণি হয়ে উঠত সরগরম। কালের বিবর্তনে বেইলি রোড এখন গুলশান, বনানী, ধানমন্ডির পরই ঢাকার অভিজাত এলাকার তালিকায়। বেইলি রোডের আভিজাত্য আগের মতো অটুট থাকলেও অতিমাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণে স্বকীয়তা হারিয়েছে। হারিয়ে গেছে ‘নাটকপাড়া’ খ্যাতি। নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, ‘মহিলা সমিতির হলটি ছিল এক সময়ের মঞ্চনাটকের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এটিকে ঘিরেই চলত মঞ্চের মানুষদের কাজ, আড্ডা। সত্তর-আশি-নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ছিল মঞ্চনাটকের রমরমা অবস্থা। ঢাকার অধিকাংশ মঞ্চনাটক এই মহিলা সমিতির হলেই মঞ্চায়িত হয়েছে। নাট্যকর্মী, কবি-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিমনা মানুষের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছিল এই নাটক সরণি। এখন অবশ্য মঞ্চনাটক শুধু মহিলা সমিতিকেন্দ্রিক নেই। নাটক সরণি ছেড়ে নাট্যকর্মী ও সাংস্কৃতিকমনা মানুষের আড্ডাস্থল বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। যদি নাটক সরণিকে শুদ্ধ নাট্যচর্চার মানুষের জন্য নাট্যচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তবেই নাটক সরণি তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।’
এখন নগরবাসীর মধ্যে রসনাবিলাস বেড়েছে। তাই নতুন কোনো ভবন উঠতে শুরু করলে রেস্তোরাঁ ওয়ালারাই সবার আগে এসে জায়গা ভাড়া নিয়ে নিচ্ছেন বেইলি রোডে। ক্রমে শাড়ি আর নাটকের পরিবর্তে খাবারের জন্য পরিচিত হয়ে উঠেছে বেইলি রোড। নাটক পাড়া-খ্যাত বেইলি রোড তাই ফাস্টফুড পাড়া হিসেবেই সবার কাছে সুপরিচিত। গাইড হাউস মিলনায়তনে যারা একসময় নাটক দেখতে যেতেন একটু ফুরসত পেলেই তারা এখন এর কোনো হদিসই পাবেন না এই মিলনায়তনের। সংস্কারের জন্য ২০১১ সালে মহিলা সমিতি ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। তখন ‘ভাঙা-গড়ার নাট্য উৎসব ২০১১’ নামে একটি উৎসবের আয়োজন করে স্মৃতিবিজড়িত মহিলা সমিতির প্রাণের মঞ্চটিকে বিদায় জানায় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান। যদিও ২০১৬ সালে মহিলা সমিতির নবনির্মিত ভবনে একটি উৎসবের মধ্য দিয়ে নাটক মঞ্চায়নও শুরু হয়। কিন্তু এরই মধ্যে নাটকের মঞ্চায়নে জমে ওঠে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হল। তত দিনে নাটক সরণি তার জৌলুস হারিয়ে ফেলে। বাণিজ্যের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয় শিল্পের এই আঙিনা। এ নিয়ে নাট্যকর্মীদের মধ্যে রয়েছে চাপা ক্ষোভ। অন্যদিকে গাইড হাউস সংস্কারের অজুহাতে বন্ধ হয়ে যায়। এখন আর প্রাণচাঞ্চল্যেভরা নাট্যকর্মীদের তেমন আনাগোনা নেই। নেই চায়ের দোকানের সামনে জড়ো হওয়া নাট্যকর্মীদের জম্পেশ আড্ডা দেওয়ার ভিড়। নেই কোনো তাদের নানা চুলচেরা বিশ্লেষণের বাকযুদ্ধ। আছে এখন ভোজন রোসিকদের রসনা তৃপ্ত করার দীপ্ত অঙ্গীকার। আছে সারিবদ্ধ জৌলুসেভরা ইমারত। আছে বিস্তৃত দোকানের আলোর ঝলকানি।
জনপ্রিয় নাটকপাড়া বেইলি রোড অনেকটাই নিষ্প্রাণ। কিন্তু বেইলি রোডকে বাঁচিয়ে রেখেছে জোড়া তারুণ্য। ঢাকা শহরের আসল ‘লাভ রোড’ যেন এখন এই বেইলি রোড বা নাটকপাড়া। যদিও এত আছের ভিড়ে শুধু আলোর স্বপ্ন দেখানো মানুষগুলোই চুপিসারে বিদায় নিয়েছে মধ্য প্রান্তর থেকে। কিন্তু স্বপ্ন দেখানো ব্রতী হওয়া মানুষগুলো কি থেমে থাকতে পারে! এক প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তরে যাদের নিরন্তর ছুটে চলা তারা থেমে থাকতে পারেনি। লক্ষ্যে অবিচল বিশ্বাসে অটল আলোকিত মানুষগুলো ঠিকই আলো দেখানোর নতুন গন্তব্যে পৌঁছেছে। এবার তারা শিল্পকলার মূল-ভূখন্ডে সীমান্তে গেড়েছে। বেইলি রোড থেকে সেগুনবাগিচা, পরিবর্তন হয় ঠিকানার। বেইলি রোডের ভাঙাচোরা মঞ্চের হাজার রজনির স্মৃতি আঁকড়ে নিয়ে ছুটে আসে নুতন গন্তব্যে। রাষ্ট্রযন্ত্রের শিল্পকলার পীঠস্থান ‘শিল্পকলা একাডেমি’ই এখন নাটকপ্রেমীদের নব্য জয়যাত্রা।