দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংকের মান কমিয়েছে মুডি'স রেটিং। ১৮ নভেম্বর সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। এছাড়া ২০১০ সালের পর প্রথমবারের মতো মুডি'স এর স্থিতিশীল ক্যাটাগরি থেকে নেতিবাচক ক্যাটাগরিতে নামল বাংলাদেশ। একইসঙ্গে বাংলাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস কমিয়েছে মুডি'স।
এদিকে, এ নিয়ে এক বছরের মাথায় দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান কমাল আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও নানা ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে সরকারের ইস্যুয়ার ও সিনিয়র আনসিকিউরড রেটিং ‘বি১’ (B1) থেকে ‘বি২’-এ (B2) অবনমন করেছে সংস্থাটি। মুডি’সসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঋণমান সংস্থা দুই বছর ধরেই দেশের ঋণমানে অবনমন ঘটাচ্ছে। বিষয়টিকে দেশের অর্থনীতি ও ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ার প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। মুডি’সের তালিকায় বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়া আর যে কয়টি দেশের বি২ রেটিং রয়েছে সেগুলো হলো কম্বোডিয়া, মঙ্গোলিয়া, রুয়ান্ডা, নিকারাগুয়া, পাপুয়া নিউগিনি ইত্যাদি।
ঋণমান অবনমনের পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতির পূর্বাভাস ‘স্থিতিশীল’ থেকে ‘নেতিবাচক’ করে দিয়েছে মুডি’স। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্যমতে, ঋণমান ও অর্থনীতির পূর্বাভাস অবনমনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদি ইস্যুয়ার রেটিং ‘নট প্রাইম’ বা ‘শ্রেষ্ঠ গুণসম্পন্ন নয়’ হিসেবে অপরিবর্তিত থাকবে।
মুডি’সের সিঙ্গাপুর অফিস থেকে বাংলাদেশের ঋণমান কমানোর তথ্য জানিয়ে গতকালই এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বিশ্বব্যাপী মুডি’স, এসঅ্যান্ডপি ও ফিচ রেটিং—যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ তিন ঋণমান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান একত্রে ‘বিগ থ্রি’ হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের ক্রেডিট রেটিং বাজারের সিংহভাগই এ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে। এ তিন প্রতিষ্ঠানের রেটিংয়ের মধ্য দিয়ে কোনো দেশের অর্থনৈতিক দৃঢ়তা, বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজ্য আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার প্রকাশ পায়। গত দুই বছরে এ তিন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই বাংলাদেশের ঋণমান কমানো হয়েছে।
এর আগে গত বছরের ৩১ মে বাংলাদেশের ঋণমান এক ধাপ কমিয়ে ‘বিএ৩’ থেকে ‘বি১’-এ নামিয়ে দেয় মুডি’স। আর ফিচ রেটিংস চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান অবনমন করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সি ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং (আইডিআর) ‘বিবি মাইনাস’ থেকে ‘বি প্লাস’-এ নামিয়ে দেয়া হয়। আর ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের সময় গত ৩০ জুলাই বাংলাদেশের সভরেন ক্রেডিট রেটিং (সার্বভৌম ঋণমান) অবনমন ঘটায় এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষায় দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিং ‘বিবি মাইনাস’ (BB-) থাকলেও ওই সময় সেটি কমিয়ে ‘বি প্লাস’ (B+) করে দেয়া হয়।
আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী তিন রেটিং প্রতিষ্ঠান ঋণমান কমিয়ে দেয়ায় বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি তথা বৈদেশিক বাণিজ্যের শর্তগুলো আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গিয়ে দেশের ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত ফি গোনার পাশাপাশি আরো কঠিন শর্তের মুখে পড়তে হচ্ছে। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের সুদও বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্বের সুপরিচিত বৃহৎ ব্যাংকগুলো বাংলাদেশী ব্যাংকের জন্য নিজেদের ক্রেডিট লাইন বা ঋণসীমা কমিয়ে দিচ্ছে বলে ব্যাংক নির্বাহীরা জানিয়েছেন।
ঋণমান আরেক ধাপ কমিয়ে দেয়ার বিষয়ে গতকাল মুডি’সের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঋণমান অবনমনের সিদ্ধান্তে মূলত বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঝুঁকি বৃদ্ধি ও নিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিষয়টিকে প্রতিফলিত করছে। এ বিষয়গুলো এসেছে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা থেকে, যার ফলে সরকারও বদলে গেছে। এসব বিষয় সরকারের নগদ অর্থপ্রবাহের ঝুঁকি, বহিঃস্থ দুর্বলতা ও ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।
মুডি’স মনে করে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্বল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে ঘাটতি পূরণে আরো বেশি স্বল্পমেয়াদি ঋণের ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। এছাড়া সম্পদের গুণগত মানের ঝুঁকির কারণে ব্যাংক ব্যবস্থার পুঁজি ও তারল্যসংক্রান্ত দুর্বলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে রাষ্ট্রের দায়সংক্রান্ত ঝুঁকিও বেড়েছে।
প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি ও বিদেশী উন্নয়ন সহযোগীরা আরো বেশি ঋণ দিলেও বাংলাদেশের বহিঃস্থ দুর্বলতাসংক্রান্ত ঝুঁকিগুলো আগের মতোই রয়ে গেছে বলে মত দিয়েছে মুডি’স। সংস্থাটি মনে করে, বহিঃস্থ দুর্বলতাসংক্রান্ত ঝুঁকির কারণে কয়েক বছর ধরেই দেশের রিজার্ভ কমছে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সামাজিক ঝুঁকি বৃদ্ধি, একটি পরিষ্কার পথনির্দেশকের অনুপস্থিতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ও জনগোষ্ঠীভিত্তিক উত্তেজনার পুনরাবির্ভাবের কারণে রাজনৈতিক ঝুঁকি বেড়েছে।
সূত্র : বণিক বার্তা।
বিডি-প্রতিদিন/শআ