সাদা রংয়ের পলিনেট হাউসের ভেতর মাচায় ঝুলে আছে থোকায় থোকায় সুমিষ্ট আঙুর ফল। আর সবুজ পাতার মাঝে উঁকি দিচ্ছে কোথাও লাল, আবার কোথাও হলুদ-সবুজ রঙের মিশ্রণের এসব আঙুল। খেতে কোনোটা মিষ্টি, আবার কোনোটা হালকা টক-মিষ্টি। তবে এসব আঙুর দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও বেশ সুমিষ্ট।
আর আঙুর ফলের এ বাগান দেখলে যে কারো মনে হবে বিদেশের মাটিতে চাষাবাদের আঙুর ক্ষেত। আসলে এটি তা নয়, দেশের মাটিতেই এখন চাষ হচ্ছে বিদেশি জাতের আঙুর। আগে মানুষের ধারণা ছিল আঙুর একটি বিদেশি ফল, এ দেশে চাষ করলে হয় টক। কিন্তু সেই ধারণা পাল্টে দিয়ে মিষ্টি আঙুর ফল চাষাবাদ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নাটোরের বাগরোম গ্রামের তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেন।
শহরতলির কান্দিভিটা এলাকায় দেড় বিঘা জমিতে বাণিজ্যিকভাবে রাশিয়ান বাইকুনুরসহ সাতটি জাতের আঙুর ফল চাষাবাদ করে সফল হয়েছেন তিনি। তার বাগানে গেলেই দেখা মিলবে মাচায় ঝুলে আছে থোকায় থোকায় টসটসে আঙুর। প্রতিদিন দেখতে আসেন দর্শনার্থীরা, আবার অনেক ক্রেতাও আসেন আঙুর ফল কিনতে।
কৃষি বিভাগ বলছেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী ও উন্নত মানের এই জাতের আঙুর ফল চাষাবাদে কোনো প্রকার কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না। কেবলমাত্র গোবর বা জৈব সার ও মাকড় মারার জন্য ভাটিমিক ব্যবহার করেই এ ফল চাষাবাদ করা যায়। তাই ফসলে জৈব-বালাইনাশক ব্যবহারের জন্য কৃষি উদ্যোক্তাদের আগ্রহ সৃষ্টি করানো হচ্ছে। পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে আঙুর চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
কৃষি উদ্যোক্তা মো. আমজাদ হোসেন জানান, গেল দুই বছর আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউব মারফতে রাশিয়ান, ইউক্রেন, ইতালি ও অস্ট্রেলিয়া থেকে ৩৫ প্রকার জাতের আঙুরেরচারা সংগ্রহ করে পরীক্ষামূলকভাবে চাষাবাদ শুরু করেন। প্রথম বছরেই আঙুর চাষে সফলতা পেয়েছেন। তবে এর মধ্যে বাছাই করে সাতটি জাতের আঙুরের ফলন ভালো এবং স্বাদে মিষ্টতা পেয়েছেন। এর মধ্যে রাশিয়ান বাইকুনুর জাতটি সবচেয়ে ভালো এবং ভালো ফলন হয়েছে। এ জাতটি দেশের আবহাওয়া ও চাষাবাদের পরিবেশ উপযোগী বলে তিনি দাবি করেন।
তিনি বলেন, প্রায় ৫০ শতাংশ নিজস্ব জমি ও লিজকৃত ২৫ শতাংশ মিলে মোট ৭৫ শতাংশ জমিতে তিনি ৩৫ প্রজাতির আঙুর চাষ শুরু করেন। এর মধ্যে গবেষণা করে রাশিয়ান বাইকুনুর জাতসহ সাতটি জাতের আঙুরের ভালো ফলন ও খেতে সুমিষ্ট হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হন। এরপর পরীক্ষিত জাত দিয়ে পরে তিনি ২৫ শতাংশ জমিতে পলিনেট হাউজের মাধ্যমে একটি মাতৃবাগান তৈরি করেছেন। এ বাগানে মোট ১২০টি চারা রোপণ করেন। চারা রোপনের ৩ মাস পর ফল এসেছে।
প্রায় ছয় মাস পর থেকে তিনি ফল বিক্রি শুরু করেছেন। তার মতে রোপণ থেকে গাছের বয়স এক বছর হলে পরিপূর্ণভাবে আঙুর ফল বাজারজাত করা সম্ভব। ইতিমধ্যে তার এ আঙুর বাগানে প্রতিটি গাছে অফসিজনে ৮ থেকে ১০ কেজি করে ফল পাওয়া যাচ্ছে। সে হিসেবে ১২০টি গাছে অন্তত গড়ে ১ হাজার ২০০ কেজি বা ৩০ মণ ফল পাওয়া যাবে। বাজার মূল্য গড়ে ৩০০ টাকা কেজি দরে হিসাব করলে যার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় কয়েক লাখ টাকা।
তিনি বলেন, সাধারণত মার্চ-এপ্রিল মাস আঙুর চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। ওই সময়ে বাণিজ্যিকভাবে বেশি পরিমাণে আঙুর ফল বিক্রি করে থাকেন। আর এখন অফসিজন হলেও বর্তমানে পাইকারি ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি ধরে বাজারে আঙুর বিক্রি করছেন। বাজারে চাহিদা থাকায় আর পেছনে ফিরে তাকাতে হচ্ছে না। তার মতে, আঙুরের এ জাত নাটোরের মাটিতে চাষযোগ্য এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, পলিনেট হাউসে ২৫ শতক জমিতে আঙুর চাষাবাদ করতে গিয়ে গাছের চারা, মাচা, পরিচর্যাসহ যাবতীয় খরচ পড়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। আঙুর বাগানে যে পরিমাণ ফল এসেছে এবং বর্তমান বাজার মূল্য অনুসারে আনুমানিক তিন থেকে চার লাখ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। আর পলিনেট হাউস তৈরি করতে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তবে এই অর্থ কৃষি বিভাগের মাধ্যমে সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া খোলা জায়গায় আরও ৭৫ শতক জমিতে আঙুর চাষাবাদ করেছেন। তবে পলিনেট হাউসে চাষাবাদে পোকার কোনো আক্রমণ নেই বাগানে। আবার তাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায় পলিনেট হাউজে। চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় তিনি গোবর সার ও মাকড় মারার জন্য ভাটিমিক ব্যবহার করেছেন। আর পলিনেট হাউসে আঙুর চাষ করায় রোগবালাই অনেক কম। কীটনাশক ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই। এজন্য এই ফলটি নিরাপদও বটে।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিলিমা জাহান বলেন, নাটোরে অনেক বিদেশি জাতের ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। আঙুর চাষের চেষ্টা অনেকেই করেছেন। কিন্তু সফল হননি। তবে আমজাদ হোসেনের বাগানে সঠিক জাত নিরুপণ হওয়ায় এবার সুমিষ্ট আঙুরের ফলন ভালো হচ্ছে এবং খেতেও বেশ সুমিষ্ট। আঙুর চাষ আগামীতে সম্ভাবনাময় ফসল হবে বলে মনে করছেন এই কৃষি কর্মকর্তা।
বিডি প্রতিদিন/এমআই