গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। ওই দিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। এরপর থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। ভারতের অভিযোগ, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় যথেষ্ঠ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সেই সঙ্গে ভারত বাংলাদেশে তথা কথিত ইসলামপন্থী শক্তির উত্থানের ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান ও চীনের দিকে ঝুঁকছে বলেও উদ্বিগ্ন ভারত।
অন্যদিকে, শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারের দাবি, তারা দেশের অর্থনৈতিক পতন ঠেকাতে এবং রাজনৈতিক, বিচার বিভাগীয় ও সরকার ব্যবস্থায় সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছে।
এর মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে একটি সম্ভাব্য বৈঠক নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে এই বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয়। বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিকাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন (বিমসটেক)-এর ষষ্ঠ এই সম্মেলনে যোগ দিতে দুই নেতার ২ এপ্রিল থেকে ৪ এপ্রিল ব্যাংকক সফর করার কথা রয়েছে।
এই বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের সাংবাদিক রাজ চেঙ্গাপ্পার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম।
‘নাথিং বাট দ্য ট্রুথ’ শিরোনামের ওই সাক্ষাৎকারে রাজ চেঙ্গাপ্পা প্রশ্ন করেন, ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সাড়ে ৭ মাস অতিবাহিত করেছে। এই সরকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শাসন ব্যবস্থা ও নিরাপত্তাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে সংস্কার পদক্ষেপ নিয়েছে। এই সরকারের পদক্ষেপগুলোকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
জবাবে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, “এ ব্যাপারে আমি তাকে মিশ্র গ্রেড দেব। কিছু ক্ষেত্রে তিনি খুবই ভাল করেছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে তিনি প্রত্যাশার চেয়ে কম সাফল্য পেয়েছেন।”
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে একটি বিষয় এখানে বুঝতে হবে সেটি হচ্ছে- হাসিনা সরকার সরকার ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। তিনি খুবই ক্ষমতাধর নেতা ছিলেন। ঠিক একইভাবে, তিনি যখন পালিয়ে গেলেন, তখন ক্ষমতার বিরাট এক শূন্যতা তৈরি হয়। আপনারা জানেন ওই সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্যারিসে ছিলেন। তিনি ৮ আগস্ট দেশ ফেরেন। আর হাসিনা পালিয়ে যান ৫ আগস্ট। এই তিন দিন আমাদের দেশে কোনও সরকার ছিল না। আর এই তিন দিনে বেশির ভাগ সহিংসতা যেমন- কারাগারে হামলা ও কিছু চরমপন্থীর জেল ভেঙে পলায়ন ইত্যাদিসহ বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা এই তিন দিনে ঘটেছে। এই অবস্থায় তিনি আসলেন এবং প্রাথমিক কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে সরকার প্রধান হিসেবে শপথ নিলেন তিনি। আমি জানি, এসব সদস্যের অনেককে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেনও না। এক্ষেত্রে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন যে, যাদেরকে ভালোভাবে চেনেনই না তাদেরকে কীভাবে তিনি মন্ত্রিসভায় নিলেন। সুতরাং এ ধরনের বেশ কিছু বিষয় এখানে আছে। এই সরকারের উপদেষ্টারা আগে একে অপরের সঙ্গে কখনও কাজ করেননি। তাদের সরকার চালানোর কোনও অভিজ্ঞতাও নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সরকারে এ ধরনের অব্যবস্থাপনা ও ভুল নির্দেশনা ছিল। তবে ৭ মাস পর আমি অবশ্যই বলব, এই সরকার এখন অনেক বেশি স্থীতিশীল। আর অর্থনীতির কথা বললে, শুরুতেই মুদ্রাস্ফীতির কথা বলব, যা ছিল সবচেয়ে বিপজ্জনক একটি বিষয়, সেটিও এখন স্থির হয়েছে। গত দুই মাসে আমরা মুদ্রাস্ফীতি কমতে দেখেছি। আর আমাদের রফতানি আগে যা ছিল তার সমপরিমাণ পর্যায়ে পৌঁছেছে। যেমন- গত বছর আমাদের রফতানি আয় ছিল ১৯ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এ বছরও আমাদের সেই সমপরিমাণ রফতানি হয়েছে। সেই সঙ্গে টাকার মানও ডলারের বিপরীতে স্থিতিশীল হয়েছে এবং আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। সুতরাং বলা যায়- হাসিনা চলে যাওয়ার সময় থেকে অর্থনৈতিক ধসের যে শঙ্কা ছিল, সেটি এখন কেটে গেছে।
এরপর রাজ চেঙ্গাপ্পা প্রশ্ন করেন- গত মাসে হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা ছাত্রনেতারা গত ২৮ মার্চ একটি রাজনৈতিক দল- জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আনুষ্ঠানিক যাত্রার ঘোষণা দিয়েছেন। আপনি জানেন- বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দুটি পরিবার কেন্দ্রিক। শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জিয়া নেতৃত্বাধীন বিএনপি। সেখানে এর বিপরীতে গিয়ে, পুরাতন সেই আখ্যান ভেঙে একটি ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ গড়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন সাবেক উপদেষ্টা ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, যেটিকে তারা-ধর্মনিরপেক্ষ বনাম ইসলামপন্থী এবং ভারত বনাম পাকিস্তানকে মিলিয়ে ফেলছেন। এই সময় এই দলের উত্থানের তাৎপর্য কী এবং কখন আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে?
এর জবাবে মাহফুজ আনাম বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটি একটি স্বাভাবিক ব্যাপার, যেমনটি আপনি বললেন- বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে দ্বিমুখী রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজমান, ফ্যাসিস্ট হাসিনার এই সবশেষ ১৫ বছরের ক্ষমতার আগে, সেই ১৯৯১ সাল, যেটিকে আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বছর বলি, যখন জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, তখন থেকেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- এই দুই দল পালাবদল করে পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে। সেখানে এটি একটি নতুন দল। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, জেনারেল এরশাদও একটি দল গঠন করেছিলেন- জাতীয় পার্টি নামে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী নামেও একটি পুরনো দল আছে। আজকে ছাত্রদের এই নতুন দল রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায় বলতে পারেন, যদিও এখনও আমরা তাদেরকে সেভাবে দেখতে পাইনি, তবে এটাও বুঝতে হবে, যেহেতু তারা এখন রাজনৈতিক দল গঠন করেই ফেলেছে, এখন তাদেরকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে পড়তে হবে। হাসিনা সরকারের পতনের ক্ষেত্রে তাদের যে সাফল্য, তারা মনে করতে পারে- এর আগে বিএনপি বা অন্য কোনও দল যা করতে পারেনি, আমরা তা মাত্র কয়েক মাসের আন্দোলনেই করে ফেলেছি, সেই আত্মবিশ্বাসের জায়গা থেকে তারা মনে করছে যে, তারা বাংলাদেশকে ভিন্ন রূপ দেবে, যেভাবে তারা বিজয় অর্জন করেছে। এটিই হচ্ছে তাদের আত্মবিশ্বাস। তবে যখন তারা রাজনৈতিক বাস্তবতায় আসবে, বিশেষ করে নির্বাচনে। তবে এই নির্বাচন কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয় বলে আমরা সবাই মনে করি। প্রথমত, এটি কমবেশি সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে যে, নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা সর্বোচ্চ আগামী বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে। এই দুই মাসেই নির্বাচন হতে পারে বলে এখন পর্যন্ত মনে করা হচ্ছে। কিন্তু ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল বলছে, তারা নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। আর এটা সহজেই বোধগম্য যে, তারা একেবারেই নতুন দল। তারা নির্বাচনে যেতে কিছুটা ভীত। কেননা, এতে খুব বেশি জনসমর্থন তারা নাও পেতে পারে। এতে তাদের জনপ্রিয়তা কমে যেতে পারে। অন্যদিকে, বিএনপি আক্ষরিক অর্থে ক্ষমতায় বসার জন্য একেবারে দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে। কারণ, এখানে দুইটি বড় দল- বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ। এখন যেহেতু আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। সুতরাং বিএনপি এখন ক্ষমতায় আসার একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে অবস্থান করছে। তাই বিএনপি নির্বাচনের জন্য খুবই আগ্রহী, আর ছাত্ররা ততটা আগ্রহী নয়। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী, যেটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন একটি বড় ফ্যাক্টর, তারা এখন দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় আছে। দেরি হলেও তাদের কোনও সমস্যা নেই। কারণ, বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো ১০/১৫ বছরও অপেক্ষা করতে পারে- এমন মনোভাব তারা ইতোমধ্যে ব্যক্ত করেছে। সুতরাং তাদের কোনও সমস্যা নেই। তারা নির্বাচন হলে অংশ নেবে, আর যদি না হয় তাতেও তাদের বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। এটিই হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি। তবে মূলকথা হচ্ছে গোটা জাতি নির্বাচন চায়। বিশেষ করে হাসিনা আমলের তিনটি নির্বাচন- ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪- ছিল খুবই জালিয়াতিপূর্ণ। এগুলোতে বিশাল সংখ্যক ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তাই বাংলাদেশে এখন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড আগ্রহ রয়েছে। এটিই বর্তমান পরিস্থিতি। আমরা খুব সম্ভবত ডিসেম্বরেই নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি, যদি কোনও নাটকীয় কারণ না ঘটে যায়।
এ পর্যায়ে সাংবাদিক প্রশ্ন করেন- ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন যে, নতুন দল এনসিপি ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী দ্বারা প্রভাবিত এবং উদ্বেগ রয়েছে যে, বাংলাদেশ তার ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থা থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। কেননা, ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারের সংস্কার কমিশন সংবিধান থেকে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়ে সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করেছে। তাহলে কি বাংলাদেশে পাকিস্তানের মতো ধর্মনিরপেক্ষতা হুমকির মুখে পড়ছে?
জবাবে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ছাত্ররা কিছু দাবি করেছে। আর সংবিধান সংস্কার কমিশন এই সুপারিশগুলো প্রস্তাব করেছে। তবে বাংলাদেশের আজকের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি এর বিরোধিতা করেছে। তারা খুব বলিষ্ঠভাবে বলেছে যে, তারা ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্রের মতো পুরনো অগ্রাধিকারগুলো ফিরিয়ে আনতে চায়। তাহলে এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, আজকের সবচেয়ে বড় দল এই পরিবর্তনগুলোর বিরোধিতা করছে, আর ছাত্ররা এগুলোকে সমর্থন করছে। সুতরাং নির্বাচনই এটিকে নির্ধারণ করবে। আর জামায়াতে ইসলামী আমাদের অনেক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তারা কখনও ৫ থেকে ৬ শতাংশের বেশি ভোট পায়নি। এমনকি বিএনপির সঙ্গে জোট বেধে তারা সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। সুতরাং এটিই হচ্ছে তাদের ঐতিহাসিক ভোটের সমর্থন। তারা হয়তো এবার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ ভোট পেতে পারে। এর চেয়ে বেশি পাবে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু আপনি যেভাবে বলছেন- বাংলাদেশ কি ইসলামপন্থী হয়ে যাচ্ছে বা পাকিস্তানের মতো হয়ে যাচ্ছে কি না? এই জায়গায় আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে এবং অন্যান্য সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানাব, বাংলাদেশকে আরও গুরুত্ব সহকারে দেখলে, আমি জানি আপনি পাকিস্তানকে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে দেখেন এবং পাকিস্তান নিয়ে আপনার নিজস্ব অভিজ্ঞতা আছে এবং সেটা নিয়ে আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না। বাংলাদেশও একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং আমার শঙ্কা এখানেই যে, ওই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বাংলাদেশকে দেখা হচ্ছে, কারণ আমরাও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। হ্যাঁ, এটা সত্য যে, আমরাও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা দেশ। এই আমরাই কিন্তু পাকিস্তানকে ভেঙেছি। তাহলে আমরা কারা? আমরা হলাম গর্বিত বাঙালি এবং গর্বিত মুসলিম।
তিনি বলেন, ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি বিরোধী দল কংগ্রেসের চেয়ে অনেক বেশি হিন্দুত্ববাদী একটি দল। আপনাদের ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার একটি ইতিহাস রয়েছে, যেটিকে বলা হয়- হিন্দুফতা ইন্ডিয়া। আপনাদের ভোটাররাই এটিকে বেছে নিয়েছে। তাই বলে ভারত কিন্তু পরিবর্তন হয়নি। এজন্য বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও কিন্তু পরিবর্তন হয়নি। এমনকি গোটা বিশ্বের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্কের কোনও পরিবর্তন হয়নি। বরং আপনারা আপনাদের নিজেদের ধর্মকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য এটি করেছেন। আমরাও যদি বাংলাদেশে আমাদের ধর্মের পাশাপাশি আমাদের সংস্কৃতিকেও একটু গুরুত্ব দিতে শুরু করি, তাহলে এতে ভয়ের কিছু নেই। অযথা উদ্বিগ্ন হবেন না যে, ও মাই গড, বাংলাদেশ তো বাঙালি হওয়ার কথা, এখন তারা মুসলিম হওয়ার কথা বলছে। এ রকম অযথা উদ্বিগ্ন হবেন না। আমি মনে করি, এখানে একটি মৌলিক আত্মদর্শন বা মৌলিক ঐতিহাসিক পুনর্বিবেচনা আসা উচিত। একটু পিছনে গিয়ে খেয়াল করুন, ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময়, বাংলার মুসলিমরা কিন্তু পাকিস্তানের জন্য ভোট দিয়েছে। যদি পরিসংখ্যান দেখেন- ১৯৪৬ সালে বাংলায় মুসলিম লিগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পায়। সেই একই বাংলায় মুসলমানরা যখন দেখল তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় হুমকির মুখে, তখন তারাই পাকিস্তানকে ভেঙে দিল। সুতরাং আমাদের দ্বৈত সভ্যতার ঐতিহ্য রয়েছে। আমরা একই সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতি ও মুসলিম সংস্কৃতির গর্বিত উত্তরাধিকারী। আর একটি বিষয়- আমরা ইসলামি সংস্কৃতির হলেও এটি আমাদের ধর্মীয় চরমপন্থী বানায় না। আমি আমার ভারতীয় বন্ধুদের আহ্বান জানাব যে, আমাদেরকে এই ফাঁদে ফেলবেন না এবং আমাদেরকে আপনাদের পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করবেন না। আমাদেরকে স্বাধীনভাবে বিচার করুন।
সংখ্যালঘু সুরক্ষার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আনাম বলেন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে। এই সরকারের প্রথম ২/৩ মাসের কথা বাদ দিলে, আমি মনে করি বাংলাদেশের অনেক সুন্দর চিত্র আপনি পাবেন। সংখ্যালঘু ইস্যু কিন্তু ভারতেও আছে। আপনাদের সব ধরনের চেষ্টা সত্ত্বেও সেখানে কিন্তু এই ইস্যুটি আছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জাতির মতো আমরাও এখানে সংগ্রাম করছি, যেমনটি ভারতও করছে। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে আমি মনে করি আমাদের একে অপরকে সহযোগিতা করা উচিত এবং সামনে এগিয়ে যাওয়া উচিত, এটিই আমার অভিমত।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনসহ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার এবং আমরা বারবার বলছি যে, ভারতের সঙ্গে আমাদের খুব ভাল একটা সম্পর্ক দরকার। আমাদের দুই দেশের বোঝাপড়া ও গভীর সহযোগিতা দরকার। এটাই বাংলাদেশের সরকারি বা আনুষ্ঠানিক অবস্থান। এটাই বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অবস্থান। তিনি বারবারই এ কথা বলেছেন। আমরা বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি বৈঠকের প্রস্তাবও করেছি।
তবে এটাও সত্য এবং আমি তা খোলামেলাভাবেই বলব। সেটি হচ্ছে- আপনি যদি দেশের সাধারণ জনগণের কাছে যান, তাহলে তাদের মাঝে এক ধরনের শক্তিশালী ভারতবিরোধী মনোভাব দেখতে পাবেন। তবে এই ভারতবিরোধী মনোভাব কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের বিপক্ষে নয়। এটি হচ্ছে- হাসিনার প্রতি বিগত বছরগুলোয় ভারতের যে সমর্থন সেটির বিপক্ষে। হাসিনা থাকলে ভারতের সহযোগিতা পাওয়া যায়, এটিকে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু হাসিনা বিগত বছরগুলোতে অত্যধিক স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছিলেন, বিশেষ করে বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে তার সরকার যে জালিয়াতি করেছে। একজন ভোটার হিসেবে একবার ভাবুন, তারা ভিন্নমতাবলম্বী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সব নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। তারা নিজেদের মতো ব্যাখ্যা তৈরি করেছে। তারা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে ভোটে জালিয়াতি করেছে। আমি মনে করি হাসিনা নির্বাচন ও গণতন্ত্রের মূলমন্ত্রটিই পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিল। তিনি মনে করতেন যে, তিনি ভোট জালিয়াতির ক্ষেত্রে এমন আত্মবিশ্বাসের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে, জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার কোনও প্রয়োজন নেই। আর বাংলাদেশের মানুষের ধারণা, হাসিনার এসব অপকর্মের পার্টনার হলো ভারত। তারা মনে করে- এ কারণেই হাসিনা এতবেশি দমন-নিপীড়নমূলক আচরণ করতেন। যাই হোক, আমি ব্যক্গিতভাবে মনে করি, বর্তমানে একটি পরিবর্তনের সময় চলছে- নির্বাচনের দিকে ধাবিত হলে সাধারণ মানুষের এই মনোভাব কমে আসবে এবং সরকারও ভারতের সঙ্গে খুব ভালো একটি সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী হবে।
এ পর্যায়ে সাংবাদিক প্রশ্ন করেন- বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, তারাও এই রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্চের শুরুর দিকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এক বিরল বক্তব্যে বলেছেন যে, বাংলাদেশ বর্তমানে এক ধরনের অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকলে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে। এক্ষেত্রে আপনার অভিমত কী?
এর জবাবে মাহফুজ আনাম বলেন, সেনাবাহিনী যদি ক্ষমতা নিতে চাইতো, তাহলে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফেরার আগে যে সময় ছিল, তাতে তাদের অনেক সুযোগ ছিল। কিন্তু তারা সেটি করেনি। তাদের পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয়েছে যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে সর্বতভাবে সহযোগিতা করছে তারা। আর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যে সতর্কতার কথা আপনি উল্লেখ করেছেন- আমি মনে করি এটি সময়োপযোগী ছিল। হয়তো কারও কারও কাছে একটু কঠোর মনে হয়েছে, তবে এটি সময়োপযোগী ছিল এবং তৎকালীন পরিস্থিতির ওপর এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে আমি মনে করি। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, সেনাবাহিনী এখানে ক্ষমতা নেওয়ার ব্যাপারে কোনও আগ্রহী নয়। এর আগে ২০০৭ সালেও সেনাসমর্থিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। তখনও তারা নিতে পারতো। তারা দুই বছর ওই সরকার ও দেশকে সহযোগিতা করেছে। তারা সুন্দর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে যথেষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তারা ক্ষমতা নেয়নি। আজও আমি এ ধরনের কোনও সম্ভাবনা দেখি না।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আনাম বলেন, ভারতের অনেক গণমাধ্যম এটিকে (অভ্যুত্থান) পাকিস্তানের আইএসআই ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আমি বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে বলেছি যে, আপনারা মনে করেন বাংলাদেশ কিছুই করতে পারে না। হয়তো ভারতের ‘র’ করায়, নয়তো পাকিস্তানের আইএসআই করায়। এখনও এই ধারণাই পোষণ করেন। বাস্তবে হাসিনার আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কটা পুরোপুরি হিমায়তি ছিল। এখন আমরা তাদের সঙ্গে কিছু বাণিজ্যিক পথ খুলছি। আপনি জানেন, পাকিস্তান একটি সার্বভৗম দেশ। আমরাও সার্বভৌম। আমি আমার ভারতীয় বন্ধুদের আহ্বান করি- আপনারা এটিকে নিরাপত্তা হুমকি মনে করবেন না। এটি মূলত একটি সার্কভুক্ত বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ মাত্র। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি এখনও মনে করি, একাত্তরে ভূমিকার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত। আমি আশা করি- তারা তাদের সেই বর্বরোচিত ঘটনার কথা তাদের বোধগম্য হবে এবং কোনও একদিন এমনটি হবে বলে আমি এখনও আশাবাদী। তবে সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক করাটা দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশের সঙ্গে এক ধরনের পরিস্থিতি শিথিলকরণ মাত্র। এর বাইরে কিছু নয়। এ ব্যাপারে আপনারা আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন। সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে
বিডি প্রতিদিন/একেএ