চল্লিশ বছরের টগবগে যুবক। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে দায়িত্বশীল পদে কর্মরত। ধূমপান করেন। উচ্চ রক্তচাপ নেই। এ ছাড়া ডায়াবেটিস ছিল না, রক্তের কোলেস্টেরল কখনো পরীক্ষা করা হয়নি। অফিসে কর্তব্যরত থাকা অবস্থায় হঠাৎ বুকে ব্যথা। সহকর্মীরা দেরি না করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে এলেন। ইসিজি করা মাত্র দেখা গেল ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক! যে ধরনের হার্ট অ্যাটাক দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা যায় যে, সবচেয়ে বড় ধমনীটি বন্ধ। এ রোগের সবচেয়ে কার্যকর চিকিৎসা হলো জরুরি ভিত্তিতে অ্যানজিওগ্রাম করে তৎক্ষণাৎ ব্লক অপসারণ করে রিং (Stent) বসিয়ে দেওয়া, যাতে হার্টের স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ পুনঃস্থাপিত হতে পারে। জরুরি ভিত্তিতে অ্যানজিওগ্রাম করার প্রস্তাব রাখা হলো। রোগীর আত্মীয়স্বজন কেউ কেউ রাজি হলেন, কেউ কেউ অন্যদের সঙ্গে ফোনে আলাপ চালাতে থাকলেন। এভাবে মূল্যবান সময় নষ্ট হতে থাকল। এরপর রাজি হলেন। রোগীকে ক্যাথল্যাব বা অপারেশন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো। রোগীর ডান হাতের রেডিয়াল ধননীতে একটি ক্যানোলা স্থাপন করতে অনুমতি চাইলেন চিকিৎসক। রোগী একটি শর্তে রাজি হলেন, অ্যানজিওগ্রাম করবেন কিন্তু রিং লাগাবেন না। অনেকটা গলায় কাঁটা আটকে যাওয়ার মতো। অ্যান্ডোসকপি দিয়ে কাঁটা দেখতে পারবেন কিন্তু অপসারণ করা যাবে না! যাই হোক রোগীর আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় অ্যানজিওগ্রাম সম্পন্ন করে মূল ধমনীটি ১০০% বন্ধ পাওয়া গেল। স্ত্রী এবং আত্মীয়স্বজনের অনুমতি সাপেক্ষে মাত্র পাঁচ মিনিটে ব্লক অপসারণ করে রিং বসিয়ে দেয়া হলো। রোগী সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা উপশম বোধ করলেন। সিসিইউতে পর্যবেক্ষণে পাঠানো হলো। বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন হার্ট অ্যাটাকের সঙ্গে সঙ্গে অ্যানজিওগ্রাম না করে প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধ প্রয়োগ করে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে পরে অ্যানজিওগ্রাম করবেন। এটি অনেক ক্ষেত্রে ভুল ধারণা এবং আত্মঘাতী ভাবনা। যদি কারও অ্যাপেনডিক্স পেটের মধ্যে ফেটে যায় তাহলে কি অপারেশন জরুরি নয়? হার্ট অ্যাটাকেও রক্তনালির চর্বির দলা ফেটে গিয়ে রক্ত জমাট বেঁধে ধমনী বন্ধ হয়ে যায়। তাই এটি আরও মারাত্মক এবং প্রাণ বিনাশকারী। আসুন বিষয়টির একটু গভীরে যাওয়া যাক। ইসিজির ধরন অনুযায়ী হার্ট অ্যাটাককে আমরা দুই ভাগে ভাগ করি- ১. STEMI হার্ট অ্যাটাক। সাধারণত হার্টের একটি বড় রক্তনালি রক্তের জমাট বা দলা দিয়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। রোগী দ্রুত খারাপ হতে থাকে। অতি সত্বর বন্ধ হয়ে যাওয়া রক্তনালি খুলে না দিলে হৃৎপিন্ডের মাংসপেশি স্থায়ীভাবে ধ্বংস হবে। হার্ট ফেইল্যুর, কার্ডিয়াক অ্যারেস্টসহ বিভিন্ন মারাত্মক জটিলতায় পড়তে হবে।
২. NON STEMI হার্ট অ্যাটাক। হার্টের কোনো না কোনো রক্তনালি সম্পূর্ণ বা আংশিক বন্ধ হয়ে মাংসপেশির ক্ষতিসাধন করে। এ ক্ষেত্রে সাধারণত এক বা একাধিক ব্লক থাকে এবং প্রায়শই কিছু না কিছু ন্যাচারাল বাইপাস তৈরি হয়ে থাকে। প্রথমোক্ত ধরন থেকে এই ধরনটি কিছুটা কম ভয়ংকর। চিকিৎসার ধরনও দুই রকম।
চিকিৎসা : ১। STEMI heart attack : হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া ধমনী যত দ্রুত সম্ভব খুলে দিতে হবে। রক্ত জমাট হয়ে বন্ধ হওয়া রক্তনালি খোলার সবচেয়ে আধুনিক এবং কার্যকর উপায় হলো জরুরি ভিত্তিতে অ্যানজিওগ্রাম করে ব্লকের লোকেশন নির্ণয় করে ব্লক অপসারণ করা। ব্লক অপসারণ করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ধাতব জালের একটি সরু পাইপ (stent) বা প্রচলিত ভাষায় যাকে রিং বলে তা ধমনীগাত্রে অ্যানজিওগ্রাম করার সঙ্গে সঙ্গে বসিয়ে দেওয়া। এটাকে জরুরি বা প্রাইমারি অ্যানজিওপ্লাস্টি বলা হয়। এটার সাফল্য প্রায় ৯৫%। এ পদ্ধতির চিকিৎসায় হৃৎপিন্ডের মাংসপেশি রক্ষা হয়, হার্টের পাম্পিং ক্ষমতা বজায় থাকে। দূরবর্তী হার্ট ফেইলুর থেকে রোগী রক্ষা পায়।
জরুরি অ্যানজিগ্রাম করার সঙ্গে সঙ্গে জরুরি অ্যানজিওপ্লাস্টির করার সুবিধা ঢাকার বাইরে অল্প কিছু জায়গায় আছে। তাই যেসব জায়গায় এ সুবিধা নেই বা যেসব কেন্দ্র থেকে রোগীর দূরত্ব দুই ঘণ্টার বেশি সেখানে ওষুধ দিয়ে ব্লক খুলে দিতে হবে। এক্ষেত্রে tenectiplase সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ। সাফল্য ৮০%-এর ওপরে। তবে দাম বেশি হওয়ায় দরিদ্র জনগণের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। এর বিকল্প হলো Streptokinase যা মফস্বল শহরগুলোতে পাওয়া যায়। সাফল্যের হার ৬৫%-এর কাছাকাছি । তবে tenectiplase বা streptokinase যাই ব্যবহার করা হোক না কেন এগুলো পুশ করার ২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ উচ্চতর কেন্দ্রে গিয়ে অ্যানজিওগ্রাম করতে হবে। যদি ব্লকের উপস্থিতি ধরা পড়ে তবে সঙ্গে সঙ্গে তা অপসারণ করে রিং প্রতিস্থাপন করতে হবে।
২. NON STEMI : এ ধরনের হার্ট অ্যাটাক তুলনামূলক কম ভয়াবহ। তবে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পুনরায় অ্যাটাক হতে পারে। হৃৎপিন্ডের মাংসপেশির ক্ষতি হবে এবং হৃৎপিন্ডের তাল কেটে ছন্দপতন সৃষ্টি করতে পারে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টসহ হঠাৎ মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এই ধরনের অ্যাটাকের ক্ষেত্রেও যত তাড়াতাড়ি অ্যানজিওগ্রাম করে ব্লকের লোকেশন, মাত্রা এবং ব্যাপ্তি নির্ণয় করে পরবর্তী চিকিৎসার ধাপ প্রয়োগ করতে হবে।
-ডা. মাহবুবর রহমান, সিনিয়র কার্ডিওলজিস্ট,
ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা