বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই সম্পর্কের গতিপথ সবসময়ই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ক্ষমতায় থাকা নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। বিএনপির পক্ষ থেকে বারংবার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। বিএনপি বিশ্বাস করে, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থাভাজন প্রতিবেশিতা এবং অভ্যন্তরীণ স্বার্থ রক্ষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্কই টেকসই হতে পারে। বিএনপি কোনো আধিপত্যবাদ, বড় ভাই ছোট ভাই কিংবা স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের ভিত্তিতে দুই দেশের সম্পর্ক নির্ধারণ হতে পারে না। ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ নীতিতে অবিচল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত করবেন বলে বারংবার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ কখনোই ভারতের শত্রু নয়, তবে বাংলাদেশের স্বার্থের সঙ্গে আপস করে কোনো সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। আমরা চাই ভারত আমাদের বন্ধু হোক, কিন্তু সেই বন্ধুত্ব হতে হবে সমতার ভিত্তিতে।’ (ভার্চুয়াল বক্তৃতা, ২০২২)।
বিএনপি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে ‘সমতার ভিত্তিতে পারস্পরিক স্বার্থের সমন্বয়’ হিসেবে দেখতে চায়। এ নিয়ে তারেক রহমান একাধিকবার বিভিন্ন ফোরামে জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা ভারত বা অন্য কোনো দেশের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি না, তবে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো পদক্ষেপ আমরা মেনে নেব না। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার-প্রতিবেশী হোন, প্রভু নন।’
বিএনপির দৃষ্টিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মূল ভিত্তি হবে নিম্নরূপ-
১.অভ্যন্তরীণ স্বার্থ রক্ষা: সীমান্তে হত্যা, পানির ন্যায্য বণ্টন এবং ব্যবসায়িক বৈষম্য ইস্যুগুলোতে বিএনপি নিরপেক্ষ, তথ্যভিত্তিক ও কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে তারেক রহমান বলেন: ‘আমাদের নীতিনির্ধারণ হবে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ দেখে, কোনো বিদেশি শক্তির মনোরঞ্জনের জন্য নয়।’
২.সীমান্ত নিরাপত্তা ও হত্যা বন্ধ: বিএনপি স্পষ্টভাবে সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগকে অগ্রাধিকার দেয়। তারেক রহমান ২০২১ সালে বলেন: ‘একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকরা সীমান্তে নিহত হবে, আর সরকার চুপ থাকবে-এটা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে সোচ্চার হবো। বিএনপির ভারত নীতিতে ভবিষ্যতে কখনো ফেলানীর লাশ কাঁটা ধরে ঝুলানোর স্পর্ধা মেনে নেবে না।
৩. নদীর পানিবণ্টন: বিএনপি তিস্তা ও অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির সুষ্ঠু বণ্টনের পক্ষে অনমনীয়। ‘আমরা চাই বৈজ্ঞানিক, স্বচ্ছ এবং আন্তর্জাতিক নীতির ভিত্তিতে পানিবণ্টন হোক। ভারতকে আমাদের ন্যায্য হিস্যার স্বীকৃতি দিতেই হবে,’-তারেক রহমান (২০২২সালের এক ভার্চুয়াল আলোচনায়)।
৪.অর্থনৈতিক ভারসাম্য: ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে সমতা রক্ষা এবং দেশীয় শিল্প সুরক্ষার পক্ষে বিএনপি। ‘আমরা মুক্তবাজারের পক্ষে, কিন্তু সেটা হতে হবে আমাদের উৎপাদকদের টিকিয়ে রাখার মতো ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশে।’-তারেক রহমান
৫. জাতীয় স্বার্থ-ভিত্তিক কূটনীতি: কোনো একতরফা সুবিধা নয়, বরং নিজস্ব স্বার্থের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলে বিএনপি। তারেক রহমান বলেন: ‘পররাষ্ট্রনীতি কারও পক্ষে নয়, দেশের পক্ষে হতে হবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে কোনো সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হয় না।’
বিএনপি যদি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে, তাহলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে পারে:
১.কৌশলগত স্বাধীনতা: পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য, যেমনটি তারেক রহমান উল্লেখ করেন: ‘বন্ধুত্বের নামে নতজানু কূটনীতি আমাদের চরিত্র নয়।’
২. চুক্তির যৌক্তিক পর্যালোচনা: একতরফা বা অসম চুক্তিগুলো তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনার মাধ্যমে পুনর্নির্মাণ।
৩. আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষা: সার্ক, বিমসটেক ও অন্যান্য আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম শক্তিশালী করা।
বিএনপি মনে করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক হবে আত্মমর্যাদাশীল, সমতার ভিত্তিতে গঠিত এবং পারস্পরিক স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বিএনপি ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে দেখলেও, বাংলাদেশ যেন কখনোই আত্মবিস্মৃত না হয়-এটাই বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনের মূল বার্তা।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কথায়: ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হবে আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরশীলতার ভিত্তিতে-তবেই দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের পথ সুগম হবে।’
ভারত প্রশ্নের বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের অবস্থানেই শেষ কথা। এ নিয়ে বিভ্রান্ত ছড়িয়ে বিএনপিকে ভারত প্রেমী সাজানোর কোনো অবকাশ নেই।
লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত