আমার আজকের নিবন্ধটি মূলত তাদের জন্য, যারা বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিয়াউর রহমানকে একদম দুচোখে দেখতে পারেন না। জিয়ার নাম শুনলে যাদের গা-জ্বালা করে অথবা যাদের শরীর-মনে প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা এবং ঈর্ষার দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে তারাও আজকের নিবন্ধ থেকে কিছুটা শান্তির পরশ পেলেও পেতে পারেন। যারা চান বাংলাদেশের মাটিতে জিয়াউর রহমান নামে যে কেউ ছিল সেই ইতিহাস মুছে ফেলতে অথবা জিয়াকে মানুষের মনমননশীলতা এবং চিন্তা থেকে চিরতরে বিদায় করে দেওয়ার জন্য, যারা নিরন্তর উল্টাপাল্টা চেষ্টা-তদবির চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তারা ইচ্ছা করলে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মপদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছালেও পৌঁছাতে পারেন। জিয়ার স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য আপনি মহামতি আলেকজান্ডারকে অনুসরণ করতে পারেন- যিনি তাঁর জাদুকরী প্রতিভা দ্বারা হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী এবং তৎকালীন দুনিয়ার একমাত্র সুপারপাওয়ার পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করেছিলেন। আপনি ভারতীয় পণ্ডিত চাণক্যের নীতিও অনুসরণ করতে পারেন, যিনি তাঁর নিয়োগকর্তা মহামতি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে অমরত্বদানের জন্য পূর্ববর্তী নন্দবংশের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অতিক্রম করে নতুন ইতিহাস রচনা করতে পেরেছিলেন। সাম্প্রতিক ইতিহাসের মহামতি সম্রাট আকবরকেও অনুসরণ করা যেতে পারে, যিনি ভারতের সবচেয়ে নাক উঁচু এবং অহংকারী রাজপুত জাতির ইতিহাসের ওপর মুঘল আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছিলেন অবলীলায়। বাংলাদেশের যেসব লোক জিয়ার স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য কাজ করছেন, তারা মূলত উল্টো রথে চলে নিজেদের সর্বনাশ ঘটাচ্ছেন এবং জিয়াকে ক্ষতি করার পরিবর্তে উপকার করে দিচ্ছেন। এ ব্যাপারে ইতিহাসের একটি কাহিনি বলে মূল প্রসঙ্গে এগোতে চাই। পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগান্তকারী যুদ্ধটির নাম গাওগেমেলা। পারস্য সম্রাটের চৌকশ এবং তৎকালীন দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ, দক্ষ এবং পেশাদার ৩ লাখ সৈন্যের বাহিনীকে মাত্র ৪০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী দ্বারা মহামতি আলেকজান্ডার যেভাবে নিজের বিজয় নিশ্চিত করেছিলেন ঠিক সেভাবে আপনিও পারেন জিয়ার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় বুদ্ধিমত্তা, কৌশল এবং দক্ষতার মাধ্যমে তাঁকে পরাজিত করতে। গাওগেমেলা যুদ্ধক্ষেত্রে আলেকজান্ডার পারস্য বাহিনীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সফলতার কারণ এবং তাদের শক্তিমত্তার কৌশলগুলো জেনে নিয়েছিলেন। পারস্য বাহিনীর আধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তি, শৃঙ্খলা এবং যুদ্ধকৌশলের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর সেগুলো মোকাবিলা করার উপায় উদ্ভাবন করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অন্যদিকে পারস্য রাজ তৃতীয় দারাফুস আলেকজান্ডারের দুর্বলতাগুলোর খোঁজ করেছিলেন এবং তাঁর অল্প বয়স, সংখ্যালঘু সৈন্যবাহিনী এবং ইতোপূর্বে বড় কোনো যুদ্ধ জয়ের অভিজ্ঞতা না থাকাকে নিজের বিজয়ের জন্য নিয়ামক মনে করে একধরনের আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল- তামাম দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে আলেকজান্ডার বিজয়ী হয়েছিলেন।
জিয়ার স্মৃতি মুছে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করার আগে আপনাকে অবশ্যই গবেষণা করে বের করতে হবে কেন জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের বিরাটসংখ্যক মানুষের হৃদয়ের রাজা হিসেবে যুগযুগান্তরে কেবল নিজের দখলদারি বাড়িয়ে চলেছেন। কেন মানুষ জিয়ার নাম পাথর, পাহাড় কিংবা প্রাসাদের গায়ে খোদাই না করে নিজেদের কলিজার ওপর লিখে যাচ্ছে অনবরত।
বাংলা ভূখণ্ডের প্রবাদতুল্য এবং কিংবদন্তির রাজনৈতিক মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব যথা আবুল হাসিম, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং কমরেড মণি সিংহ কেন বিএনপির মতো একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারলেন না। অথবা আবুল হাসিমের খেলাফতে রব্বানী পার্টি, ভাসানীর ন্যাপ, ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি এবং মণি সিংহের কমিউনিস্ট পার্টি কেন জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপির মতো স্থায়িত্ব পেল না! কেন বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতারা বারবার বিএনপিতে যোগদান করছেন। অন্যদিকে বিএনপির কোনো শীর্ষনেতা কেন এরশাদ জমানা ছাড়া অন্য সময়ে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিলেন না। এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দেওয়া বিএনপি নেতারা কেন পুনরায় তাঁদের মূল দলে ফিরে এলেন।
জিয়াবিরোধীদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস। কোন প্রেক্ষাপটে যুদ্ধ শুরু হলো, কীভাবে যুদ্ধ চলল, কারা যুদ্ধ করল এবং কেন করল ইত্যাদি প্রশ্নের নির্মোহ উত্তর না জানা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলা আর নিজেকে তামাশার বস্তু অথবা সার্কাসের সং বানানোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। জিয়া শুধু গণমানুষের হৃদয় নয়, দেশের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের হৃদয়ের মণিকোঠাতেও ভালোবাসার মিসাইল স্থাপন করে গেছেন। সেই মিসাইল আজ অবধি কেন অন্য কেউ অপসারণ করতে পারল না অথবা নতুন ভালোবাসার মিসাইল অথবা মন্ত্র দ্বারা ওই সব প্রতিষ্ঠানের হৃদয়পট দখল করা হলো না?
জিয়া কি মুক্তিযোদ্ধা নাকি পাকিস্তানের তৎকালীন সরকারের খয়ের খাঁ ছিলেন তা বোঝার জন্য জিয়াবিরোধীদের আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সেনাবাহিনী, রাষ্ট্র ও রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক সম্পর্ক, প্রভাব এবং সামগ্রিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এবং সুবৃহৎ সেনাবাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। সেই বাহিনীর একজন মেজরের পক্ষে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকা সম্ভব কিনা। অথবা পৃথিবীর কোনো সেনাবাহিনীর একজন মেজরকে সেই দেশের সরকার প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করার জন্য অনুমতি দিয়ে সরকারবিরোধীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করার অনুমতি দেওয়ার নজির আদৌ আছে কি?
বৃহৎ একটি সেনাবাহিনীর একজন জুনিয়র কর্মকর্তা যদি শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে হঠাৎ বলে ওঠেন ‘আই রিভোল্ট’ তাহলে তাঁর কী পরিণতি হতে পারে? পৃথিবীর ইতিহাসে এযাবৎকালে কতজন মেজর একটি সরকার, একটি সেনাবাহিনী এবং একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বলতে পেরেছেন- আমি বিদ্রোহ করলাম! নিশ্চিত মৃত্যু, তা-ও আবার কোর্ট মার্শাল অথবা ক্রসফায়ার জানার পর একজন পাগল, নির্বোধ অথবা শিশু ছাড়া অন্য কোনো প্রকৃতি বা জাতের মানুষ এমনতরো দুঃসাহস দেখাতে পারে? সে কী ভীরু কাপুরুষ-নাকি মহাবীর! সে কী বেইমান, বিশ্বাসঘাতক নাকি মহৎ প্রাণ দেশপ্রেমিক!
ব্যক্তি জিয়ার সততা, প্রশাসনিক দক্ষতা, স্বজনপ্রিয়তার ঊর্ধ্বে ওঠে কাজ করার দুর্দমনীয় ক্ষমতা, আপন পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং তাদের রাষ্ট্রীয় কর্মের ধারেকাছে ভিড়তে না দেওয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত রাখার যে দুরন্ত সাহস, অনমনীয় মনোভাব এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখাতেন তা কী জনগণ পছন্দ করত নাকি এসব কারণে জিয়াকে লোকজন ছি ছি রবে ঘৃণা জানাত তাও খুব ভালোভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। জিয়ার প্রশাসনিক সংস্কার, আইন প্রণয়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, চোরাচালান রোধ, জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড, খাল কাটা, কৃষিবিপ্লব, বিদেশনীতি, অভ্যন্তরীণ নীতি, অর্থব্যবস্থার সফলতা এবং সর্বস্তরে স্থিতিশীলতা আনয়নের প্রক্রিয়া-পদ্ধতি তৎকালীন জনগণ এবং সাম্প্রতিককালের জনমানুষ কীরূপে বিবেচনা করে, তা মূল্যায়ন ব্যতিরেকে জিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা আত্মঘাতী পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার অংশগ্রহণ, একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া এবং তাঁর অধীন সেক্টরটির কর্মকাণ্ড কী বীরত্বপূর্ণ ছিল নাকি তিনিসহ তাঁর পুরো বাহিনী, কমান্ড ও সেক্টর পাকিস্তানিদের দোসর ছিল? মুক্তিযুদ্ধকালীন তাঁর বীরত্ব অথবা তাঁর ভাঁওতাবাজি, ছলচাতুরী, অনৈতিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি সম্পর্কে দলিলপত্র না থাকলে তাঁকে কোনোভাবেই মোকাবিলা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে কালুরঘাট বেতার থেকে জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণা অথবা অন্য কারও পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করাটি মূল্যায়ন করার আগে আরও কতগুলো প্রশ্নের জবাব খোঁজা আবশ্যক। কেন অন্য কোনো সেক্টর কমান্ডার, সেনাপতি বা উপসেনাপতি জিয়ার আগে বা পরে জিয়ার মতো করে কোনো ঘোষণা দিলেন না। কেন অন্য কোনো বেসামরিক ব্যক্তির ঘোষণা দেশবাসীর কর্ণকুহরে ঢুকল না। কেন দিলেন না। কেন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জিয়ার আগে বা পরে অথবা মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না। এমনকি প্রবাসী সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও কেন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিলেন না, মুজিবনগর ঘটনার আগে!
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা তাঁর নেতা ও পিতা বইতে অভিযোগ করেছেন যে তাঁর পিতা সর্বোচ্চ চেষ্টা-তদবির করেও টেপরেকর্ডারে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে স্বাধীনতার ব্যাপারে কোনো ঘোষণা সংগ্রহ করতে পারেননি। এ অবস্থায় শূন্য টেপরেকর্ডার নিয়ে তিনি ভারতে পাড়ি দিতে বাধ্য হন। তাজউদ্দীনকন্যার বই পাঠ করার পর অনেক পাঠক মন্তব্য করেছেন, তিনি তো জিয়ার মতো বাংলাদেশ ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একটি ঘোষণা দিতে পারতেন! স্বাধীনতাযুদ্ধের সুদীর্ঘ ৯ মাসের মধ্যে যুদ্ধরত সেনাবাহিনী, মুক্তিবাহিনী, ভারতীয় মিত্রবাহিনী, পাকিস্তানি হানাদার এবং তাদের দোসরদের ভূমিকা নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করতে না পারলে কারও পক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং ভাবধারা হৃদয়ে ধারণ করা সম্ভব নয়। আর মুক্তিযুদ্ধের ধারকবাহক ছাড়া মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে কোনো কথা গ্রহণীয় নয়।
রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়ার সময়কালকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই তাঁর ক্ষমতার সাড়ে তিন বছর এবং ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বেকার সাড়ে তিন বছর ইতিহাসের নিরপেক্ষতার কষ্টিপাথর দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। দুটি সময় সম্পর্কে তৎকালীন জনগণ এবং বর্তমান জনগণের ধারণা সম্পর্কে আপনাকে ওয়াকিবহাল হতে হবে। কোন সময়কালে জনগণ খুশি ছিল অথবা কোন সময়ে জনগণের মন ক্লান্তি, ক্লেদ, ক্ষোভ এবং হতাশায় পূর্ণ ছিল। জিয়ার জীবদ্দশায় কতজন মানুষ গোপনে তাঁর মৃত্যু কামনা করতেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর কতজন মানুষ উল্লাস প্রকাশ করেছেন তার সমীকরণ জিয়াবিরোধীদের অবশ্যই করতে হবে। জিয়ার মৃত্যুর পর মানুষের হৃদয়ে শোক ও আনন্দের বন্যার তুলনামূলক বিচার ছাড়া জিয়ার স্মৃতি মোছন-প্রছনে হতে দেওয়া ঠিক হবে না।
রাজনীতিবিদ জিয়ার সফলতা ও ব্যর্থতা এবং বিএনপির ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার আগে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস আপনাকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রায় ৬৫ বছর পর ভারতীয় কংগ্রেস স্থিতিশীলতা ও ক্ষমতা পেয়েছিল ভারত স্বাধীন হওয়ার মাধ্যমে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০৬ সালে এবং প্রতিষ্ঠার ৪২ বছর পর ক্ষমতা এবং স্থিতিশীলতা পেয়েছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে। পরে তা পরিবর্তিত হয়ে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের অংশীদার হিসেবে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় সরকার গঠনের অংশীদার হলেও দলের মধ্যে স্থিতিশীলতা ছিল না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালেও দলের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়নি। আওয়ামী লীগ সত্যিকার স্থিতিশীল দল হিসেবে নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কর্ম শুরু করতে পেরেছিল ১৯৯১ সালে এরশাদশাহির পতনের পর। এ ক্ষেত্রে জিয়া প্রতিষ্ঠিত বিএনপির প্রাথমিক স্থিতিশীলতার গোপন রহস্যটি অবশ্যই জিয়াবিরোধীদের খুঁজে বের করতে হবে।
প্রয়াত জিয়াউর রহমান সম্পর্কে উল্লেখিত বিষয়াদির পাশাপাশি তাঁর হাঁটাচলা, কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি, প্রতিশ্রতি পালন, ধর্মকর্ম, সদাচার, জনকল্যাণ, দানখয়রাত, পোশাক-আশাক, রুচিবোধ, সময়ানুবর্তিতা, আহার-নিদ্রা ও বিশ্রামের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক সচ্ছলতা ও আভিজাত্য, তাঁর পিতামাতা-আত্মীয়স্বজনের সুনামগুলো না জেনে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অসম্ভব। কারণ প্রকৃতির সহজ নিয়ম হলো, প্রতিটি কর্মের সমান প্রতিক্রিয়া রয়েছে। প্রকৃতির এই সূত্রমতে মন্দকর্ম প্রতিহত করতে হয় মন্দকর্ম দ্বারা। অন্যদিকে ভালো কর্মকে অতিক্রম করতে হলে কেবল অধিকতর ভালো ও সৎকর্মের সফল বাস্তবায়ন দরকার।
প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উল্লেখিত কর্ম জীবনাচরণ এবং স্মৃতিগুলো মূল্যায়ন করার পর আপনাকে অবশ্যই এসব কর্মের হালনাগাদ লভ্যাংশ এবং কিছু বোনাস যোগ করে নিজের শুভ কর্মগুলোর তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। এরপর আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন কোন কাজগুলোর স্মৃতি আপনি মুছতে চান? আপনি যদি সৈনিক অথবা সেনাপতি জিয়াকে মোকাবিলা করতে চান তবে অবশ্যই আপনাকে সৈনিক এবং সেনাপতি হতে হবে, তা-ও আবার তাঁর সমপর্যায়ের পদপদবিধারী না হলে চলবে না। আপনি যদি মুক্তিযোদ্ধা কীর্তিগাথা এবং বীরত্বকে অতিক্রম করতে চান, তবে আরও একটি মুক্তিযুদ্ধ এবং আরও একটি রণাঙ্গন ছাড়া আপনার আশা পূর্ণ হওয়া অসম্ভব। আপনি যদি জিয়ার চেয়েও অধিকতর সাহস, দৃঢ়তা এবং ব্যক্তিত্বভরা কণ্ঠ নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চান, তবে মহান আল্লাহকে বলতে হবে আপনার চলমান বর্তমানকে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের উত্তাল দিনগুলোতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য।
প্রেসিডেন্ট জিয়া রাষ্ট্রনায়ক জিয়া অথবা সরকারপ্রধান জিয়ার স্মৃতি মোচনকারীকে অবশ্যই সমপদের অধিকারী হতে হবে। রাজনীতিবিদ জিয়ার স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য বিএনপির চেয়েও বড় একটি দল জিয়ার চেয়েও কম সময় নিয়ে গড়ে তোলার কৃতি আপনার থাকতে হবে। জিয়ার ভিশন-মিশন এবং উৎপাদনশীলতা অতিক্রম করার জন্য মরুর বুকে সবুজ বনায়ন করার সৌভাগ্য এবং সফলতার সমন্বয় করে আপনাকেও আরাফাতের ময়দানের মতো অন্য কোনো বরকতময় স্থানে নিমগাছের আবাদ করতে হবে। আর আপনি যদি প্রয়াত জিয়ার স্মৃতিকে মানুষের মানসপট থেকে আপনার শুভকর্ম দ্বারা মুছে ফেলার ব্যাপারে সার্থকতা অর্জনের স্বপ্ন দেখেন তাহলে আপনাকেও প্রয়াত হয়ে ঊর্ধ্বলোকে গিয়ে অপেক্ষা করতে হবে, কারণ কোনো জীবিত লোক কোনো দিন মৃতলোকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে পারেনি। সফল মানুষের জীবনের প্রকৃত সার্থকতা শুরু হয় মৃত্যুর পর, কারণ জীবিতকালের যেকোনো একটি ঘটনা যেমন তার সারা জীবনের সফলতাকে ম্লান করে দিতে পারে, তেমনি জীবন সায়াহ্নের একটি মাত্র কর্ম তার সারা জীবনের সব ব্যর্থতা, দুর্নাম ও বেদনার স্মৃতি মুছে দিতে সক্ষম।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক