ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা এখন ধ্বংসস্তূপ। এর মাঝেও যেসব বাড়িঘর ও বসতির শেষ চিহ্ন রয়েছে, তাও একের পর এক ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় বিলীন হয়েছে জনবসতি। এ ভয়াবহ বর্বরতার বিপরীতে বিশ্বমানবতা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে থাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ-শিশুরা এখন শুধু সৃষ্টিকর্তার করুণা প্রার্থনা করে চলেছেন। সূত্র : আলজাজিরা, রয়টার্স।
খবরে বলা হয়, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার খান ইউনিসের বাসিন্দা জামাল আল-মধুন গতকাল বলেছেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ঘুমাচ্ছিলাম... এবং হঠাৎ করেই ঘরগুলো মাটির সঙ্গে মিশে গেল। বাসার ছাদ নিরীহ নারী ও শিশুদের মাথার ওপর ভেঙে পড়ল। পাহাড়-পর্বতকে ছাইয়ে পরিণত করে দেওয়ার মতো করে শিশুদের ওপর ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হলো।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন আমরা ধ্বংসস্তূপ থেকে আটজনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছি। তাদের সবাই নারী ও শিশু। একজন পুরুষও নেই। এই নিরীহ নারী ও শিশুদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।’
আরেক খবরে বলা হয়, গাজায় প্রাণঘাতী ভয়াবহ হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের। গতকাল ১২ ঘণ্টায় যে হামলা চালানো হয়েছে তার অধিকাংশই খান ইউনিসে। সেখানে শিশু ও নারীসহ কমপক্ষে ১৯ জন নিহত হয়েছেন।
ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী আবাসিক বাড়ি ও অস্থায়ী তাঁবুতেও হামলা চালিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো মানুষ আটকা পড়ে আছে। তাই সেখানে মৃতদেহ ও জীবিতদের উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে। নিহতে সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। কেবল খান ইউনিসেই নয়, গাজা শহরের জেইতুন পাড়াতেও রাতভর হামলা চালানো হয়েছে। দক্ষিণ গাজার রাফা ও বেইত লাহিয়াতেও ক্রমাগত বোমা হামলা চলছে।
খবরে বলা হয়, অবরুদ্ধ গাজায় প্রতিদিন শত শত বোমাবর্ষণ করছে ইসরায়েল। দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চালানো অব্যাহত এ হামলায় ৫০ হাজারের বেশি নিরীহ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। এখনো প্রতিদিন নির্বিচারে অগণিত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হচ্ছে। নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর এই নির্মমতায় তারা পাশে পাচ্ছে না কাউকে। ইসরায়েলি হামলায় গাজার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটেছেন ফিলিস্তিনিরা। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে যখন তারা আশায় বুক বেঁধে তাদের বিধ্বস্ত আঙিনায় ফিরেছেন তখন আবারও নিরস্ত্র এ মানুষদের ওপর বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে। এখন আর তাদের বাঁচার কোনো অবলম্বন নেই। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। যেন শুধু মৃত্যুর জন্যই তারা এখন অপেক্ষা করছেন। দুই হাত তুলে প্রার্থনা করছেন সৃষ্টিকর্তার কাছে।
এদিকে গাজার মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহ থেকে সাংবাদিক হিন্দ খোদারি বলেছেন, ইসরায়েলি সেনারা রাফা ও খান ইউনিসের মাঝে করিডর তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ করিডর প্রতিষ্ঠা করা হলে গাজার বাকি অংশ থেকে রাফা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলি সেনারা এ অঞ্চলের কাছাকাছি আসা যে কোনো লোকজনকে লক্ষ্য করে নির্বিচার গুলিবর্ষণ করছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য বর্তমানে একমাত্র উন্মুক্ত অঞ্চল হলো উপকূলীয় সড়ক ঘেঁষে থাকা আল-রশিদ করিডর।’
গাজায় গণহত্যা বন্ধে বিশ্বব্যাপী ‘নো ওয়ার্ক নো স্কুল’ কর্মসূচি : গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে আজ বিশ্বব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়েছে নিপীড়িত গাজাবাসী। গণহত্যা বন্ধের দাবিতে বিশ্বের সব দেশে একযোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছে তারা। গাজাবাসীর এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট দিয়েছেন। ইংরেজি অক্ষরে ছবিতে লেখা রয়েছে, ‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল আনটিল জেনোসাইড স্টপস’ অর্থাৎ গণহত্যা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত কাজ ও স্কুল বন্ধ।’ ছবির ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, ‘হ্যাঁ, সংহতি জানাই। আগামীকাল (আজ) ৭ এপ্রিল ইসরায়েলি দখলদারিত্ব এবং গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ধর্মঘটে যোগ দিন।’
আজ বিশ্বব্যাপী হরতাল পালনে আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। এক ফেসবুক পোস্টে এই তরুণ নেতা লিখেছেন, মানুষ ও মুসলিম হিসেবে এসব (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-অফিস-আদালত) বন্ধ রাখাতেই আমাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ হওয়া উচিত নয় বরং দল-মতনির্বিশেষে সারা দেশের ছাত্র-জনতা একসঙ্গে রাজপথে নেমে ইসরায়েলি খুনিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো উচিত। আমরা হয়তো এই মুহূর্তে আমাদের গাজার ভাই-বোনদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে পারব না। কিন্তু তাদের লড়াইয়ের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে নিজ ভূমির রাজপথে অন্তত নামতে পারব।
তিনি বলেন, এনসিপি, বিএনপি-জামায়াত বা কোনো (রাজনৈতিক) দলের ব্যানারে নয় বরং দল-মতনির্বিশেষে ‘বাংলাদেশ’ ব্যানারে আগামীকাল আমরা রাজপথে নেমে গাজার গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি। খুনি, রক্তপিপাসু নেতানিয়াহুর বিপক্ষে স্লোগান দিতে পারি। প্রত্যেক জেলায় ছাত্রজনতার প্রতিনিধি হিসেবে কয়েকজন মিলে দায়িত্ব নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এই কর্মসূচি পালিত হোক। ৭ এপ্রিল কোনো দল, মত, পক্ষের হয়ে নয় বরং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গাজার মজলুম মানুষের পক্ষে হোক। একই আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির শাখার সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম। নিজের ফেসবুকে পেজে তিনি লিখেছেন, গাজার প্রতি বৈশ্বিক সংহতির অংশ হোন। আগামীকাল (আজ) সোমবার, ৭ এপ্রিল ‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল’ এই কর্মসূচি সফল করুন।
প্রসঙ্গত, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় বোমা হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। সর্বশেষ হামলায় দক্ষিণের খান ইউনিসে এক সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। উত্তরের গাজা সিটিতে দুই শিশুও নিহত হয়েছে। গাজার খান ইউনিসে এক ভবনে ইসরায়েলি বাহিনীর চালানো বোমা হামলায় কমপক্ষে আটজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গত ১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী প্রতিদিন গড়ে ১০০ ফিলিস্তিনি শিশুকে হত্যা বা আহত করছে। এ সংখ্যা বিশ্বব্যাপী গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।