গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের তিন দিনব্যাপী পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হয়েছিল কলেজ ক্যাম্পাসে। পদ্মাপাড়ের এ শিক্ষাঙ্গনেই প্রাথমিক পরবর্তী স্কুল-কলেজজীবন কেটেছে আজকের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের। একুশে ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা দিবস ছিল পুনর্মিলনীর দ্বিতীয় দিন। এদিন সকালে বর্তমান ক্যাডেটদের হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা উদ্বোধন করেন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, দেশের বরেণ্য কূটনীতিবিদ, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন ভাষা, দেশপ্রেম ও শিক্ষাজীবনের রঙিন দিনগুলোর কথা। বক্তব্য শেষে সুযোগ পেয়ে অগ্রজ বিবেচনায় পুত্রসম উপস্থাপক তাঁকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, কূটনীতি বা কূটনীতিবিদ কথাটা তাঁকে বিব্রত করে কিনা? কারণ কূট শব্দটি তো খারাপ অর্থে প্রয়োগ হয়। যেমন কূটকৌশল, কুটচাল, কুটনামি ইত্যাদি। তৌহিদ হোসেন হালকা গোঁফের নিচে স্বভাবজাত মুচকি হাসি দিয়ে যা বললেন, তার সারমর্ম হলো- কিছু শব্দের অর্থ নির্ভর করে প্রয়োগের ওপর। যেমন স্বার্থপর শব্দটি নিঃসন্দেহে খারাপ। কিন্তু দেশের স্বার্থে বা দেশের স্বার্থরক্ষায় কেউ যদি শতভাগও স্বার্থপর হন, তবে তিনি নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। সুতরাং কূটনীতিবিদরা যদি দেশ ও জনগণের স্বার্থে কূটনীতিচর্চা ও প্রয়োগ করেন, তবে তাতে বিব্রত নয়, তৃপ্ত হওয়া উচিত। তুমুল করতালিতে প্রায় দুই হাজার প্রাক্তন ও বর্তমান ক্যাডেট ও অন্য অতিথিরা তাঁর কথায় শাবাশী সাড়া দিলেন। সেই সকালে দেশবিদেশ থেকে আসা হাজারো প্রাক্তন ক্যাডেট ও বর্তমান ক্যাডেটরা শহীদ মিনারের পথে দাঁড়িয়ে এক সুরে গেয়েছিলেন- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। অনেকেরই বুকে হাত আর চোখে অশ্রু ছিল সেদিন। গভীর শ্রদ্ধাভরে অনেকেই স্মরণ করেছেন জুলাই বিপ্লবে প্রাণ হারানো ও অঙ্গহানি হওয়া বীর ছাত্র-জনতার কথা। আসলে দেশটাকে আমরা সবাই ভালোবাসি এ কথাটা যেন মাঝে মাঝে রক্ত দিয়ে আর জীবন দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় কিছু সংশপ্তককে।
রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে সেদিনের এমন ঘটনা মনে পড়ল বিগত কয়েক দিনে কূটনীতিবিদদের অবিরাম ছুটে চলা দেখে। রমজান মাসজুড়ে এবং ঈদ-পরবর্তী সপ্তাহে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর দিয়ে বলা চলে ঝড় বয়ে গেছে। সেই ঝড় এখনো থামেনি। কারণ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির চারটি নিয়ামক বা নীতিনির্ধারণী ফ্যাক্টর হলো জাতিসংঘ, আমেরিকা, চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক। আর সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মির প্রভাব বিবেচনায় মিয়ানমারও কূটনীতিবিদদের নিত্যদিনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘ ছাড়াও এ চার দেশের নেতাদের সঙ্গেই কূটনীতিবিদদের বসতে হয়েছে বিগত মাসজুড়ে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশে তাঁর সাম্প্রতিক সফরকালে ১৪ মার্চ রোহিঙ্গাদের শরণার্থীশিবির সফর করেন ও লাখো রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করেন। সঙ্গে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর কূটনীতিবিদরা। এ সফর নিয়ে গত সপ্তাহে ‘রোহিঙ্গাদের আগামী ঈদ প্রসঙ্গ’ শিরোনামে লিখেছি। আজ সংবাদ শিরোনামে দেখছি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সম্মত হয়েছে মিয়ানমার। সুতরাং অভিনন্দন ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও দেশের সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকদের।
গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানিকতা শেষে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস কূটনীতিবিদ ও অন্য সঙ্গীদের নিয়ে চীন সফরে যান। তাঁকে নেওয়ার জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিশেষ বিমান পাঠিয়েছিলেন, যা কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের প্রতি চীন সরকার ও চীনা জনগণের অনন্য সম্মান ও দুই দেশের সম্পর্ককে চীনের দিক থেকে মূল্যায়নের একটি মর্যাদার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচ্য। সফরকালে চীনের দিক থেকে ২১০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ঋণ ও অনুদান প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে দেশের প্রাণভোমরা তথা নদীগুলোর ৫০ বছরের ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়নে নদী ব্যবস্থাপনায় সফল চীনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়। তিস্তা নদীর উৎস পূর্ব হিমালয়ের পাউহুনরি থেকে, যা কাঞ্চনজঙ্ঘার ৭৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সিকিম, ভারত ও তিব্বত অঞ্চলে অবস্থিত। এ অঞ্চলে চীনের ব্যাপক প্রভাব। এ ছাড়াও হিমালয় তথা নেপাল থেকে উৎপন্ন বহু নদী ভারত হয়ে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে এসেছে। আন্তরাষ্ট্রীয় এসব নদী ও নদী ব্যবস্থাপনার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও যথাযথভাবে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণে অতীতে আমরা নদী ব্যবস্থাপনা ও দেশের অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্সা আদায়ে ব্যর্থ হয়েছি কিংবা ব্যক্তিস্বার্থে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছি বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। সুতরাং চীন যদি আগামী ৫০ বছর দেশের নদীব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে, তবে তা বিভিন্ন অভিন্ন ও আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্সা আদায়, জলাধার নির্মাণ ও পানি সংরক্ষণ এবং খরা ও বন্যা প্রতিরোধে বাংলাদেশ চীনের মতোই সফল হতে পারে। একসময় হোয়াংহো নদীকে চীনের দুঃখ বলা হতো, ব্যবস্থাপনার গুণে যা আজ আশীর্বাদ। বেশ কিছু নদী ও হ্রদের পানিদূষণ সাফল্যের সঙ্গে রোধ করতে পেরেছে চীন। আর ২০২৫ সালের মধ্যেই মাটির ওপরে থাকা ৮৫% পানি মানসম্মত করার লক্ষ্যে অনেকটাই এগিয়ে গেছে তারা। (সূত্র : জেমস টাউন ফাউন্ডেশন, চায়না ব্রিফ, আগস্ট ২০২৩)। চীনের অভিজ্ঞতা ও সহায়তা পেলে তিস্তা, গোমতী কিংবা ফেনী নদীর মতো অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনা এবং ঢাকার চারপাশে থাকা দূষিত নদীর পানির মান উন্নয়ন সম্ভব হতে পারে। তবে এসব কিছুই নির্ভর করে পরবর্তী সময়ে কূটনীতিতে অভিজ্ঞ, দুর্নীতিমুক্ত ও নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম নিয়ে এগিয়ে আসা সরকারি ও বেসরকারি অংশীজনদের আন্তরিকতার ওপর।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা সফল বিপ্লবকালে শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের ভারতে আশ্রয় লাভ, তাদের প্ররোচনা, উত্তেজনা সৃষ্টির প্রয়াস, ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সৃষ্টির নিন্দনীয় প্রচেষ্টা দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। পক্ষান্তরে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যের সঙ্গে সমুদ্রের সান্নিধ্য বা সংযুক্তি না থাকা ও বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সেই সাত রাজ্যের বাণিজ্য, উৎপাদন ও আমদানি-রপ্তানির সুযোগ নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্য ভারতীয় কূটনীতিবিদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ এঁকে দেয়। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশকে সমুদ্র তথা বঙ্গোপসাগরের একক অভিভাবক ঘোষণায় ভারতের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ঘুম হারাম হওয়ার জোগাড়। এমতাবস্থায় থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হলো বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে থাকা দেশগুলোর সংগঠন বিমসটেকের শীর্ষনেতাদের ষষ্ঠ সম্মেলন। এ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যোগ দিলেও প্রথমদিকে তাঁদের মধ্যে সাইড লাইন বা দ্বিপক্ষীয় সাক্ষাৎকারের বিষয়টি ছিল অনিশ্চিত। এ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অনৈতিকভাবে যাচ্ছেতাই প্রচারণা চালাতেও কার্পণ্য করেনি। তবে শেষ পর্যন্ত এ সাক্ষাৎকার সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। সাক্ষাৎকারে বিচক্ষণ প্রধান উপদেষ্টা বরাবরের মতো বিদেশি বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী মোদির হাতে জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতিনির্ভর বই উপহার দেননি। বরং প্রধানমন্ত্রী মোদি কর্তৃক ২০১৫ সালের ৩ জানুয়ারি ভারতের মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ১০২তম ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে স্বর্ণপদক প্রদানের বাঁধাই করা ছবিটি উপহার দিয়েছেন। ভাবখানা এমন যে কোটি কোটি ভারতবাসীর চোখেও ড. ইউনূস যে একজন জ্ঞানী ও সম্মানিত ব্যক্তি, তা সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। এখন শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্সা আদায়, সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা এবং প্রয়োজনে ভারত ভ্রমণে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানের বিষয়গুলোর যৌক্তিক সমাধান হতে পারে উভয় দেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক রেখে, যুগপৎ এগিয়ে চলার অন্যতম অনুষঙ্গ।
এদিকে কূটনীতিপাড়া ও ব্যবসায়ী মহলের জন্য এক আতঙ্কের নাম যেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নতুনভাবে আবারও নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর সাম্প্রতিক সাড়াজাগানো পাল্টা শুল্ক ঘোষণায় বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। চীন, কানাডা, মেক্সিকোসহ বহু দেশের ওপরই এমন বা আরও উচ্চহারে শুল্ক আরোপের বিরূপ প্রভাবে ধস নেমেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে কাজ করলেই কেবল এ বিপর্যয় কাটানো সম্ভব, যা কূটনীতিবিদদের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা। শেষ করব সুয়েজ খালসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে সফলতার জন্য শান্তিতে নোবেলজয়ী কানাডার ১৪তম প্রধানমন্ত্রী (১৯৬৩ থেকে ১৯৬৮) ও কূটনীতিবিদ লেস্টার বোলস মাইক পিয়ারসনের একটি বাণী স্মরণ করে। তিনি বলেছেন, ‘কূটনীতিতে সবকিছুই সমভাবে জটিল ও সহজ’।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]