মাত্র আড়াই মাস বয়সে মাকে হারিয়েছে বর্তমানের ১০ মাসের ফুটফুটে শিশু সুবাইয়া। তার জীবনের প্রথম ঈদ। অথচ এই আনন্দের দিনটিতে মাকে ছাড়াই কাটাতে হবে অবুঝ ছোট্ট শিশুকে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে কোনো স্বাভাবিক মৃত্যুতে সুবাইয়া মা হারা হয়নি, তাকে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করেছে বিদায়ী স্বৈরাচার সরকারের নির্দেশে অতর্কিতভাবে গুলিবর্ষণকারীরা।
এদিকে, বর্তমানে বাচ্চাটির বাবা জীবিত থাকা সত্বেও মেয়ের খোঁজ-খবর নেন না বলে জানিয়েছেন শহীদ সুমাইয়ার পরিবার। এজন্যই মা-বাবাহীন সুবাইয়ার ঈদের উৎসব কাটবে নানি-খালা-মামার কোলে।
২০ বছরের তরুণী গার্মেন্টস কর্মী সুমাইয়া। স্বামী জাহিদ ও আড়াই মাসের কন্যা সুবাইয়াকে নিয়ে সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর এলাকার ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করতো। দেশব্যাপী ছাত্র-জনতা যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করে যাচ্ছিল তখন নিজ বাড়ি থেকে সিদ্ধিরগঞ্জে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন সুমাইয়া। মায়ের বাড়িতে তার অবস্থানকালে ছাত্র-জনতা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা।
২০ জুলাই বিকালে যখন বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গে প্রশাসনের সংঘর্ষ হচ্ছিল তখন (নাসিক) সিদ্ধিরগঞ্জের ১নং ওয়ার্ডের পাইনাদী নতুন মহল্লা এলাকায় মায়ের বসবাসরত ভবনের ছয়তলার ফ্ল্যাটে নিজের শিশু মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আন্দোলনের দৃশ্য দেখছিলেন সুমাইয়া। বারান্দায় দাঁড়ানোর কয়েক মিনিটের মাথায় আচমকা আকাশে উড়া হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া একটি গুলি ওই ফ্ল্যাটের বারান্দার গ্রীল ছিদ্র হয়ে তার মাথায় লাগে। এসময় রক্তাক্ত অবস্থায় ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে শহীদ ওই নারী। তখন তাৎক্ষণিকভাবে পরিবারের সদস্যরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সড়কেই মৃত্যু হয় তার।
এদিকে আসছে ঈদুল ফিতরকে ঘিরে প্রতিটি মুসলমানদের মনে আনন্দ আর উৎসহ থাকলেও নিহত সুমাইয়ার শোকে তার পরিবারে উৎসহের ছিটেফোঁটাও নেই বলে জানিয়েছেন তারা। ঈদে সুবাইয়ার জন্য কেমন প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে সুমাইয়ার মায়ের বাড়িতে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
সুমাইয়ার বড় বোন জান্নাত আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমাদের বোন না থাকায় এবার আমাদের ভেতর ঈদের আনন্দ বা আমেজ নাই। পুরা রমজান মাসে আমরা কোনো মার্কেট না করে গত রবিবার কিছু কেনাকাটা করেছি। সুবাইয়া যেখানে তার মায়ের আদর-যত্ন পাওয়ার কথা সেখানে আমার মা আর আমরা তার খেয়াল রাখি। আমরা যেমনই করি মা তো মা-ই। আমার বোন মারা যাওয়ার পরের তিনদিন বাঁচ্চাটা চোখ খোলেনি। পরে যখন চোখ খুলেছিল যাকেই দেখতো তাকিয়ে থাকতো। আমাদের ধারণা ও তার মাকে বুঝতে পারতো। আমাদের সবচেয়ে বড় দুঃখ আমরা সবাই ঈদ করতেছি কিন্তু আমার বোন নাই। আমার মা প্রায় সময়ে আমার বোনের কবরের সামনে গিয়া কান্নাকাটি করে আসে।
শিশুটির বাবাসহ তার পরিবার খোঁজ খবর নেয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলে, সুমাইয়ার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর ওর জামাই আসছিল। এরপর থেকে আর তাগো খোঁজ-খবর নাই। আমরা সুবাইয়ার জন্য ঈদের কেনাকাটা করছি গতকাল। আমাদের একটাই দাবি বোনের হত্যার বিচার হোক।
সুমাইয়ার দুলাভাই মো. বিল্লাল বলেন, আমার শালিকার মৃত্যুর পর থেকে আমার শাশুড়ি বাচ্চাকে লালন-পালন করে যাচ্ছে। তার মামা খালারাও তাকে অনেক যত্ন করে। অথচ শিশুর বাপ কোনো খোঁজ খবর রাখে না ওর। আমরা যদিও ওর বাবার জায়গা পূরণ করতে পারবো না, তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার শাশুড়ি তার মেয়ে চলে যাওয়ার পর থেকে এই সুবাইয়ার মধ্যে সুমাইয়াকে খুঁজে পায়। আমাদের একটাই আশা মানুষজনের সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন নাই। আমাদের একটাই চাওয়া সরকার যেনো ওর একটা ব্যবস্থা করে এবং ওর দায়িত্ব নেয়। আমরা যে মামলাটা করেছি আমাদের চাওয়া এই সরকারের মাধ্যমেই দ্রুত যেনো মামলাটার বিচার হয়। কারণ লংটামে বিচার হলে দেখতাছি অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত