হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথায় ‘জাতি’ কথাটির যে অর্থ, তার সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ‘জাতি’ কথাটির অর্থ এক রকম নয়। এই পার্থক্য সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা আমাদের অর্জন করতে হবে। জাতীয়তাবোধ, জাতি, জাতীয়তাবাদ, জাতিরাষ্ট্র ইত্যাদি নিয়ে রাজনীতিবিদদের ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা মত আছে। এ জন্য এসব বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার বেলায় প্রত্যেককেই নিজের অবস্থান, উদ্দেশ্য ও চিন্তার স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট করে ব্যক্ত করা সমীচীন।
বাংলা ভাষার দেশে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং রাজনীতি ও প্রগতি ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা-সমালোচনা ও ধ্যানধারণার অগ্রগতি অল্পই হয়েছে। জনজীবন, নেতৃত্ব, জাতিরাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে সৃজনপ্রয়াসী চিন্তা ও প্রচেষ্টাও সন্তোষজনক নয়। সব কাজের জন্যই দুনিয়াব্যাপী সর্বত্র শিক্ষার দরকার হয়।
নেতা হওয়ার জন্য রাষ্ট্র ও রাজনীতি বিষয়ে কিন্তু বাংলাদেশে রাজনীতি করার কিংবা শিক্ষা-দীক্ষার দরকার হয় না।
বাংলাদেশে রাজনীতি দেখা যাচ্ছে রাজনীতিবিদদের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। অরাজনৈতিক নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় সংসদের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে নির্বাচিত রাজনীতিকদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যাবেন—এটা কী রকম রাজনীতি? এই রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশ কি জনগণের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠছে? এই ধারার রাজনীতি নিয়ে বাংলাদেশে কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে?
মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছানিরপেক্ষভাবে প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে, মানুষের সমাজও পরিবর্তিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনশীলতার মধ্যে মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এবং সম্মিলিতভাবে নিজের ও নিজেদের কল্যাণে পরিবর্তনের ধারাকে কিছু পরিমাণে হলেও কাজে লাগাতে পারে। সভ্যতা সৃষ্টির, সংস্কৃতি সৃষ্টির ধারা মানুষের এই শক্তিই নিয়ামক।
মানুষ নিজেকে এবং নিজের পরিবেশকে উন্নত করতে পারে। নিজেকে উন্নীত না করে কেবল পরিবেশকে—সামাজিক, প্রাকৃতিক পরিবেশকে—উন্নীত করতে চেষ্টা করলে চেষ্টা সফল হয় না। এ জন্যই ‘বদলে যাও, বদলে দাও’—এই স্লোগান কোনো কোনো জাতির মধ্য থেকে উচ্চারিত হয়েছে। বাংলাদেশে এখন রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ‘মেরামত’ করার, সংস্কার করার উদ্দেশ্যে যেসব স্লোগান ও বক্তব্য ব্যক্ত করা হচ্ছে, তা লক্ষ করে এসব কথা আমার মনে জাগছে। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের বেলায় শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি সীমাবদ্ধ না রেখে মানুষের মনের দিকটাতেও যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে।
সংস্কার কারা চাইছেন, কেন চাইছেন তা-ও বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো, রাজনৈতিক নেতারা স্বদেশের রাজনীতিকে নিজেদের আয়ত্তে রাখতে না পারার ফলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে যেসব কথা বলছে, সেগুলো তো বাংলাদেশে স্বাধীন রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের পরিপন্থী। কেবল চলতি উত্তেজনা ও উপস্থিত অস্থিরতায় হারিয়ে গেলে সুফল হবে না। প্রয়োজনীয় নেতৃত্বের অভাবে বাংলাদেশ ক্রমে তার রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব হারাবে। যদি জনশক্তি জাগ্রত ও সক্রিয় হয়, সম্ভবপর বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠে, তাহলে জনগণের রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ রক্ষা পাবে। সেই ঐক্য গঠনের জন্য অবশ্যই নেতৃত্ব লাগবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কি বাংলাদেশে উন্নততর রাজনৈতিক চিন্তা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠতে সহায়তা করবে?
অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদ জাতীয় সংসদের সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারের ও পুনর্গঠনের যে সংকল্প ঘোষণা করে সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন, তার সাফল্যের জন্য আইনের শাসনে বিশ্বাসী সর্বজনীন কল্যাণে নিবেদিত যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দরকার, তা কবে কিভাবে সৃষ্টি করা যাবে—সে প্রশ্ন অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা কোনো সামান্য ব্যাপার নয়। সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন আইনের শাসন ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় অপারগ হয়েছে, তখন সেনাপতিরা ক্ষমতা দখল করেছেন। সেনাশাসকরা অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হলেও রাষ্ট্রের স্বাধীনতা রক্ষা এবং প্রধানত ধনিক-বণিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করতেন। দরিদ্র মানুষদের কল্যাণে কিছু কাজ করতেন। সেনাপতিদের ক্ষমতায় আসার সুযোগ বন্ধ করার জন্য হাসিনা সরকার সংবিধানে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের যে ব্যবস্থা করে গেছে, তাতে সেনাপতিরা এখন আর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের কথা ভাবেন না। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলকারী সেনাপতিদের সরকারকে আর স্বীকৃতি দেবে না বলে ঘোষণা দেয়। ‘Military Withdrawal from Politics’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রয়াত অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের একটি বই আছে। তাতে এ বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি লেখেননি। তিনি পক্ষপাতমুক্ত অবস্থানে থেকে একটি ঐতিহাসিককালে ক্রমাগত সামরিক শাসন জারির এবং ক্ষমতায় থাকার তথ্যাদি সংকলন করেছেন।
বাংলাদেশে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগের গুরুত্ব উপলব্ধির জন্য যেসব সমস্যার বিবেচনা অপরিহার্য বলে আমার মনে হয়েছে সেগুলোর কয়েকটি এখানে উল্লেখ করলাম। দৃষ্টিভঙ্গিকে বিস্তারে ও গভীরতায় প্রসারিত করতে হবে। ভাসা ভাসা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচারব্যবস্থা ও আইন-কানুন সংস্কার, শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতির সংস্কার, প্রশাসনব্যবস্থার সংস্কার, কৃষির ও কৃষকদের কল্যাণ, শিল্পপতি ও শ্রমিকদের কল্যাণে উন্নততর বিধি-ব্যবস্থার, দুর্নীতি কমিয়ে চলার (বলা হয় চিরকালের জন্য দুর্নীতি দূর করার) জন্য কার্যকর বিধি-বিধান প্রবর্তন করার, বিদেশে অর্থপাচার বন্ধ করার, ঋণখেলাপিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার, প্রশাসনব্যবস্থার এবং পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতি ও অবৈধ উপায়ে সম্পত্তি অর্জন করার সুযোগ বন্ধ করার, অসৎ উপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় আইন-কানুন জারি করা এবং সব আইন কার্যকর করা—রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য এসব কথা সরকারি মহল থেকে, ধনিক-বণিকদের থেকে, কথিত বিশিষ্ট নাগরিকদের থেকে, সাংবাদিকদের থেকে ক্রমাগত প্রচার করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বারা এসব করা সম্ভব হবে না বলে মত প্রকাশ করছেন, রাষ্ট্র সংস্কার প্রসঙ্গে এসব কথা সংবাদপত্রে ও রেডিও-টেলিভিশনে ক্রমাগত প্রচার করা হচ্ছে। পরিবর্তন করা ও পরিবর্তিত ব্যবস্থাকে সচল রাখার উপায় সম্পর্কে তেমন কিছু বলা হচ্ছে না।
চীনে কী রকম রাষ্ট্রব্যবস্থা কিভাবে চলছে, রাশিয়ার রাজনীতি, সরকার ও জনজীবন কেমন, পূর্ব ইউরোপের কিছু রাষ্ট্রে কল্যাণরাষ্ট্রের নীতি অবলম্বন করে কেমন চলছে, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া কেমন চলছে ইত্যাদিও তলিয়ে দেখা দরকার। নিতান্ত ভাসা ভাসা পর্যবেক্ষণ নিয়ে, নিজেদের ইতিহাসকে ভালোভাবে না জেনে, বাংলাদেশে যে ব্যবস্থাই প্রবর্তন করা হোক না কেন, তাতে সব উন্নতিশীলতা সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর এবং রাজনৈতিক নেতাদের থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে কোনো পরিকল্পনা ও মেয়াদি কর্মসূচি ঘোষণা না করার ফলে সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনগুলো থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের পরিকল্পনা ঘোষণা করা হচ্ছে। আমি বোকার মতো ভাবতাম, বাংলাদেশের রাজনীতি উন্নতিশীল হবে, রাজনৈতিক নেতারা প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন এবং পরম কল্যাণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন এবং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে প্রগতিশীল রূপে গড়ে তুলবেন। আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা এবং রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমান অবস্থায় নিপতিত হয়েছে।
অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের শুভ ইচ্ছা ও পরিকল্পনা সফল হোক, রাজনীতির শুভকর উত্থান দেখা দিক, বাংলাদেশ সর্বজনীন গণতন্ত্রের রাষ্ট্ররূপে গড়ে উঠুক, মহান রাজনৈতিক নেতার উত্থান দেখা দিক। সবার কল্যাণ হোক, প্রত্যেকের কল্যাণ।
লেখক: বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সভাপতি, বাংলা একাডেমি, ঢাকা