পবিত্র রমজানের সমাপ্তিতে আনন্দের বারতা নিয়ে পৃথিবীর মুসলমানদের ঘরে ঘরে হাজির হচ্ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদ আনন্দ। ঈদুল ফিতর অর্থ রোজা খোলার আনন্দ। কিন্তু কেন সেই আনন্দ? আনন্দের জন্য তো কোনো কারণ থাকতে হবে! সুখবর পেলেই তো মানুষ আনন্দিত হয়! এক মাস রোজার সাধনার পর এদিনে সেই সাধনার পুরস্কার হিসেবে ক্ষমা পাওয়াই সেই আনন্দের কারণ। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহতায়ালা ঈদের দিন ফেরেশতাদের মাঝে রোজাদারদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘হে ফেরেশতারা আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিকবান্দার বিনিময় কী হতে পারে?’ ফেরেশতারা বলেন, হে প্রভু পুণ্যরূপে পুরস্কার দান করাই তো তার প্রতিদান। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব (রোজা) পালন করেছে। অতএব দোয়া করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে। আমার মর্যাদা, সম্মান, দয়া ও বড়ত্বের কসম আমি তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদের মাফ করে দেব। বায়হাকি। ঈদুল ফিতরের ওয়াজিব কাজ দুটো। প্রথমত সদকাতুল ফিতর (ফিতরা) আদায় করা। দ্বিতীয়ত ঈদের নামাজ আদায় করা। প্রথমটি কেবল ধনীদের ওপর ওয়াজিব আর দ্বিতীয়টি ধনী-গরিব সবার ওপর ওয়াজিব। ফিতরার মাধ্যমে গরিবদের ঈদের সময়ের খাদ্যের ব্যবস্থা এবং ফিতরা প্রদানকারীর রোজার ভুলত্রুটি ক্ষমা করা হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘অশ্লীল ও অনর্থক কথাবার্তার কারণে সিয়ামে ঘটে যাওয়া ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো দূর ও মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য রসুলে কারিম (সা.) সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। আবু দাউদ।
ঈদুল ফিতরের দিন ভোরবেলায় যার কাছে নিসাব পরিমাণ মাল থাকবে তার ওপরই সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে। জাকাতের জন্যও নিসাব পরিমাণ মাল থাকতে হয় আবার সদকাতুল ফিতরের জন্য নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হতে হয়। তবে জাকাতের জন্য বছরপূর্তি অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের এক বছর পূর্তি হওয়া শর্ত কিন্তু সদকাতুল ফিতরের জন্য এক বছর শর্ত নয়। এমনকি ওই ব্যক্তি যদি এর আগের দিন কিংবা পরের দিনও সম্পদহীন থাকে কিন্তু ঘটনাক্রমে ঈদুল ফিতরের দিন ভোরবেলায় তার পরিবারের প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ মাল থাকে তাহলেই তার এবং তার অধীনস্থদের সবার পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। নিসাব হলো নিত্যপ্রয়োজন ও ঋণের অতিরিক্ত কারও কাছে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ নগদ অর্থ থাকা।
সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ হলো এক সা (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) খাদ্যদ্রব্য, খেজুর, যব, কিশমিশ অথবা পনির অথবা এর মূল্য। তা ছাড়া অর্ধ সা (১ কেজি ৬৫০ গ্রাম) গম দিয়েও সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা এক সা (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম) খাদ্য অথবা এক সা খেজুর অথবা যব অথবা কিশমিশ অথবা পনির দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম। সহিহ বুখারি।
ঈদের মূল আনুষ্ঠানিকতা হলো ২ রাকাত নামাজ। ঈদের নামাজ ওয়াজিব। সাধারণ নামাজের মতোই ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। তবে তাতে প্রথম রাকাতে তাকবিরে তাহরিমাহর পর সানা পড়ে ৩টি তাকবির এবং দ্বিতীয় রাকাতে কিরাত পড়ার পর রুকুর আগে ৩টি তাকবির মোট অতিরিক্ত ৬টি তাকবির দেওয়া ওয়াজিব। সুন্নত হলো উন্মুক্ত মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করা। সূর্য উদিত হওয়ার পর এবং নামাজের হারাম সময় অতিবাহিত হওয়ার পরই ঈদের নামাজের সময় শুরু হয়। বেশি দেরি না করে আগে আগে ঈদের নামাজ পড়ে নেওয়া উত্তম।
মুস্তাহাব হলো, ঈদের দিনে খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে মিসওয়াকসহ অজু করে ফজরের নামাজ নিজ মহল্লার মসজিদে আদায় করা। ভালোভাবে গোসল করা। সাধ্যমতো উত্তম (পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন) পোশাক পরিধান করা। সুগন্ধি ব্যবহার করা। সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা। ঈদের জামাতে যাওয়ার আগে কিছু খেজুর বা মিষ্টি দ্রব্য খাওয়া। সামর্থ্য অনুযায়ী উত্তম খাবারের ব্যবস্থা করা। অধিক পরিমাণে দানসদকা করা। এতিম মিসকিন ও গরিবদের সাধ্যমতো পানাহার করানো। দেরি না করে, পায়ে হেঁটে তাকরিরে তাশরিক বলতে বলতে ঈদগাহে যাওয়া। ইমাম মিম্বারে বসলে তাকবিরে তাশরিক বন্ধ করে তাঁর আলোচনা শোনা। আনন্দ প্রকাশ করা। ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া, অন্য রাস্তা দিয়ে ফেরা। দোয়া ও ইস্তিগফার করা। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়া। শুভেচ্ছাবিনিময় করা। ঈদের দিন রোজা রাখা হারাম। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। বুখারি।
♦ লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ ও পরিচালক, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর