কেউ বাবার জন্য, কেউ ভাইয়ের জন্য, কেউ সন্তানের জন্য আবার কেউ স্বামীর জন্য অপেক্ষা। এই বুঝি আসছে। শহরের মতো দরজার কড়া নাড়া নয় গ্রামের বাড়ির সামনে (দরজায়) এসে ডাক দিচ্ছে এমন মুহূর্ত, ক্ষণ অতিবাহিত করছে উপকূলের জেলে পরিবারের সদস্যরা। হারানো স্বজনদের স্মৃতিই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তাদের। অবুঝ শিশুর চাহনি যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। ঠিক এমন চিত্র উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটায়। এখানে অধিকাংশ জেলে পরিবারে নেই ঈদ আনন্দ। একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যদের হারিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটে এসব পরিবারের সদস্যদের।
যার চলে যায় সেই বুঝে না পাওয়ার বেদনা। স্বজনহারা কষ্টে বুক ফেটে যায়। স্বজনহারা পরিবারের সদস্যদের এমনিতেই দিনক্ষণ চলছে কষ্টে এরপর যদি আসে ঈদ। আর সেই ঈদ যদি হয় স্বজন ছাড়া।
পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের রুহিতা, পদ্মা, চরলাঠিমারা, জিনতলা, টেংরা, চরদুয়ানী ইউনিয়নের দক্ষিণ চরদুয়ানী, তাফালবাড়িয়া, জ্ঞানপাড়া, গাববাড়িয়াসহ একাধিক গ্রামের অসংখ্য জেলে পরিবারে নেই ঈদ আনন্দ। একে তো কর্মক্ষম ব্যক্তি বছরের পর বছর ধরে সাগরে গিয়ে নিখোঁজ অপরদিকে অভাবের সংসারের টানাপোড়েন এমন অবস্থায় ঈদ তাদের জন্য আদার ব্যাপারির জাহাজের খোঁজ নেয়ার মতো অবস্থা।
উপকূলের জেলে জীবনের ঈদের খোজ খবর নিতে গিয়েছিলাম রুহিতা গ্রামের। ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বরে সাগরে মাছ শিকার করতে গিয়েছিলেন কালু মাঝি, ঘুর্নিঝড়ে মিধিলির কবলে পড়ে নিখোঁজ হন ২৫ জেলে। নিখোঁজ জেলে পরিবারের সদস্যদের আর্তনাদ এখনো থামছে না। উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তারা আদৌ বেঁচে আছেন কি-না, জানেন না স্বজনেরা। তবু প্রিয়জনের আশায় বুক বেঁধে নীরব অপেক্ষায় দিন কাটছে এসব জেলের পরিবারের সদস্যদের।
নিখোঁজ জেলেরা হলেন আবু কালাম (৬০), মজিবর চাপরাশি (৪৫), ইউসুফ আলী (৩৫), মো. জাফর (৩৫), আব্দুস সত্তার (৬৫), নাদিম (২০), মো. বেল্লাল (২৫), মো. ইয়াসিন (২৫), আউয়াল বিশ্বাস (৪৮), সফিকুল ইসলাম (৪০), মো. ফারুক (৩৫), আব্দুল খালেক (৫০), মো. নান্টু মিয়া (৩৫), মাহতাব (৪৫), সিদ্দিক মৃধা (৪৩), কালু মিয়া (৪০), মো. মনির হোসেন (৪৫), সহিদুল ইসলাম (৪০), মো. সুবাহান খাঁ (৭১), মো. ইউনুস সরদার (৭৩), মো. খলিল (৬১), আব্দুর রব (৬০), মো. আল আমিন (৩৫), মো. লিটন (৪১) ও মো. কালাম (৩৬)। তাদের মতো অসংখ্য জেলে সাগরে গিয়ে নিখোঁজ রয়েছে।
রুহিতা গ্রামের কালু মাঝির মেয়ে রাইসা মনি বলেন, প্রতিমুহূর্তে বাবার জন্য মন কাঁদে। মাঝেমধ্যে নিজের অজান্তে বাবাকে ডাক দিই। বাড়ির দরজায় দৌড়ে আসি, এই বুঝি বাবা আসছেন। এতোদিন কিভাবে কেটেছে, আমাদের সঙ্গে না থাকলে কেউ বুঝবেন না। প্রায় দিনই না খেয়ে থাকি। সংসার কিভাবে চলে কেউ খোঁজ নেয় না। মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকায় মায়ের পাশে থাকতে হয়। শশুর বাড়িতে থাকি না।
প্রতিবেশী নিখোঁজ ইউসুফের ছোট ভাই ইয়াকুব আলী বলেন, ভাই দুই সন্তান রেখে সাগরে যান। আর ফিরে এলেন না। সন্তানদের মুখের দিকে তাকালে নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। সারা দিন বাবা বাবা বলে কান্না করে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি, আজও ভাইকে পাইনি। জীবিত আছেন না মারা গেছেন, তা-ও জানি না।
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রোকনুজ্জামান খান বলেন, উপকূলের জীবন-জীবিকা, জেলেদের নিয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে। প্রতিনিয়ত পরিবার হারাচ্ছে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। নিখোঁজ পরিবারকে বিভিন্ন সময় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়েছে, যা চলমান রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পাথরঘাটায় ১৯৯৩ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত নিখোঁজ জেলেদের তালিকাসংবলিত স্মৃতিফলক করা হয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাঁদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে ১৮৮ জেলে পরিবারের মাঝে ২০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/এএ