সন্তানের প্রতিপালন মা-বাবার পবিত্রতম দায়িত্ব। তবে এই দায়িত্ব পালনে সবার অবস্থান ও ভূমিকা সমান নয়, সমান সবার সাফল্য ও ব্যর্থতার পরিমাণ। দ্বিনি শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা, আদব-শিষ্টাচারের পাঠদানসহ নানা বিবেচনায় অভিভাবকদের সাফল্য ও ব্যর্থতা পরিমাপ করা যায়। আর হিসাবে তাদের ভেতর আছে একাধিক শ্রেণি বিভাগ।
নিম্নে ইসলামের দৃষ্টিতে অভিভাবকদের সাফল্যের শ্রেণি বিভাগ বর্ণনা করা হলো—
১. উভয় জগতে ক্ষতিগ্রস্ত : যে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শুধু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করাকে যথেষ্ট মনে করে, তারা তাদের দ্বিনি শিক্ষা ও তারবিয়াতের দিকে একেবারেই মনোযোগ দেয় না অথবা সামান্য মনোযোগকেই যথেষ্ট ও ফলপ্রসূ মনে করে। এ ধরনের অভিভাবকরা পরকালে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কেননা তারা ইহকালকে পরকালের ওপর প্রাধান্য দিয়েছে। আর পরকালের ক্ষতিই প্রকৃত ক্ষতি।
এই শ্রেণির লোকদের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, ‘বরং তোমরা পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দিয়েছ, অথচ পরকালই উত্তম ও চিরস্থায়ী।’ (সুরা : আলা, আয়াত : ১৬-১৭)
এই শ্রেণির অভিভাবক ইহকালেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান) উঠে যাবে এবং মূর্খতা বাড়বে, তখন কিয়ামতের বড় বড় আলামত প্রকাশ পাবে। তন্মধ্যে একটি এই যে দ্বিনি শিক্ষাবিমুখ সন্তানরা স্ত্রীর আনুগত্য করবে, আর মায়ের অবাধ্য হবে।
অন্যদিকে তারা বন্ধুবান্ধবের খুবই খাতির-তোয়াজ করবে, কিন্তু মা-বাবার কোনো খোঁজখবর নেবে না।’
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২২১৬)
করণীয় : এই শ্রেণির অভিভাবকের দায়িত্ব হলো, যেভাবে তারা সন্তানের পার্থিব শিক্ষা নিশ্চিত করতে পরিশ্রম করে, একইভাবে বা তার চেয়েও বেশি মৌলিক ধর্মীয় শিক্ষা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হওয়া। যেন সন্তানরা বিশ্বাস ও আমল, সমাজ ও নৈতিকতা, লেনদেন ও আদব-কায়দা সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তাদের হৃদয় ও মস্তিষ্কে বদ্ধমূল করতে পারে, যাতে ফিতনার এই যুগে নাস্তিকতা ও ধর্মত্যাগের কোনো ঢেউ সন্তানদের ঈমানের সম্পদ থেকে বঞ্চিত করতে না পারে।
২. পার্থিব জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত : যে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শুধু ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে নিযুক্ত করে এবং ধর্মীয় জ্ঞানের বাইরে কোনো কিছু শেখার অবকাশ দেয় না, বরং জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তাদেরকে পার্থিব জীবন পরিচালনার জন্য মৌলিক ও প্রয়োজনীয় জাগতিক শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত করে—এই শ্রেণির অভিভাবক ও তাদের সন্তানরা পার্থিব জীবনে ক্ষতিগ্রস্ত। যদিও পরকালীন ক্ষতির তুলনায় পার্থিব জীবনের ক্ষতি খুবই সামান্য, তবু এই জেনে-বুঝে এবং সুযোগ থাকার পরও এই ক্ষতি বহন নিষেধ করে।
ইসলামের শিক্ষা হলো মুমিন পার্থিব জীবনের প্রয়োজনীয় পার্থিব জ্ঞান অর্জন করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ যা তোমাকে দিয়েছেন তার দ্বারা আখিরাতের আবাস অনুসন্ধান করো এবং দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলো না; তুমি অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেয়ো না। আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালোবাসেন না।’
(সুরা : কাসাস, আয়াত : ৭৭)
করণীয় : এই শ্রেণির অভিভাবকের দায়িত্ব হলো, পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় জাগতিক শিক্ষার পাঠদানের ব্যবস্থা করা, যেন মুসলমানের সন্তানরা কোনো পরিস্থিতির মুখাপেক্ষী না হয় এবং তাদের পার্থিব জীবনও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
৩. উভয় জগতে লাভবান হওয়া : যে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের আধুনিক ও ধর্মীয় উভয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে এবং সন্তানের নীতি-নৈতিকতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়; সন্তান পার্থিব জীবনে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করে এবং পরকালে মা-বাবা ও অভিভাবকদের জন্য নাজাতের মাধ্যম হয়—এই শ্রেণির অভিভাবক উভয় জগতে লাভবান। এটাই সন্তান প্রতিপালনে ইসলামের নির্দেশিত পদ্ধতি। কেননা পবিত্র কোরআনে দোয়া শেখানো হয়েছে, ‘আর তাদের মধ্যে যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দাও এবং আখিরাতে কল্যাণ দাও। আর আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করো। তারা যা অর্জন করেছে তার প্রাপ্য অংশ তাদেরই। বস্তুত আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২০১-২০২)
কাতাদা (রহ.) বলেন, দুনিয়ার কল্যাণ হলো শারীরিক সুস্থতা ও পর্যাপ্ত সম্পদ। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, দুনিয়ার কল্যাণ হলো জ্ঞান ও আল্লাহর ইবাদত। আর সর্বসম্মতিক্রমে পরকালীন কল্যাণ হলো জান্নাত।
(তাফসিরে কুরতুবি)
করণীয় : তারা অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য, তাদের উচিত এই পদ্ধতিকে প্রসারিত করা এবং পরিবার ও গোত্রের অন্যান্য অভিভাবকের কাছে একই পদ্ধতিতে পাঠদানে আহ্বান ছড়িয়ে দেওয়া।
৪. যাদের ক্ষতি সীমাহীন : যে অভিভাবকরা অর্থনৈতিক অক্ষমতা বা অন্য কোনো কারণে—চাই তা যৌক্তিক হোক বা অযৌক্তি, সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সঙ্গে আপস করে; তারা সন্তানদের ধর্মীয় ও জাগতিক কোনো প্রকার শিক্ষা দেয় না। তারা তাদের নিজেদের কোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত করে। এই শ্রেণির অভিভাবকের ক্ষতি সীমাহীন। কেননা উত্তম শিক্ষাই সন্তানের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। আল্লামা আশরাফ আলী থানবি (রহ.) তাঁর বইয়ে খলিফা ওমর (রা.)-এর যুগের একটি মামলার বিবরণ দিয়েছেন। যার মূল কথা হলো, একজন পিতা সন্তানের অত্যাচারের শিকার হয়ে খলিফার দরবারে অভিযোগ পেশ করল। ওমর (রা.) সন্তানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলেন, এই পিতা জন্মের পর তার জন্য ভালো নাম নির্বাচন করেনি, তাকে উত্তম শিক্ষা দেয়নি এবং ভালো নারীর সঙ্গে বিয়ে দেয়নি। তখন ওমর (রা.) এ মামলা খারিজ করে দিলেন এবং পিতাকে বললেন, তুমিই প্রথমে নিজের সন্তানের ওপর জুলুম করেছ। এর ফল তোমাকে ভোগ করতেই হবে।
(তারবিয়্যাতে আওলাদ, পৃষ্ঠা-১১৯)
করণীয় : তাদের উচিত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি বিবেচনা করা যে তাদের এই কাজ সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক বিষের চেয়ে কম নয়। মৌলিকভাবে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে সন্তানদের যোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা উচিত, যাতে জ্ঞানের আলোতে পুরো ঘর আলোকিত হয় এবং তারা দুনিয়া ও দ্বিন উভয় ক্ষেত্রেই উপকৃত ও লাভবান হতে পারে।
আল্লাহ সবাইকে সত্য উপলব্ধি করার তাওফিক দিন। আমিন।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন